শিশু হাসপাতালে বাড়ছে নিউমোনিয়া রোগী

ঢাকার শিশু হাসপাতালে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই রোগী ভর্তি হচ্ছে। হাসপাতালের ১৯ শয্যার নিউমোনিয়া ওয়ার্ড এরই মধ্যে পূর্ণ হয়ে গেছে। ছবি: আহমেদ দীপ্ত

ঢাকা শিশু হাসপাতাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউটের নিউমোনিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি সাড়ে তিন বছরের আনিশা। নাকে লাগানো অক্সিজেনের নল।

প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে গত ২৬ নভেম্বর নরসিংদীর বেলাবো থেকে তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। অবস্থার অবনতি হলে নেওয়া হয় আইসিইউতে। তিন দিন আইসিইউতে থাকার পর পাঁচ দিন আগে তাকে ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়।

মেয়ের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মা শাহিনুর আক্তার। বলেন, 'আইসিইউ থেকে ওয়ার্ডে আনার পর ওর অবস্থার উন্নতি খুব ধীরে হচ্ছে।'

'আমার মেয়ের ছোটবেলা থেকেই শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল। প্রতি শীতেই ওর কষ্ট বেড়ে যায়। এবার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাওয়ায় আমরা ওকে নিয়ে এখানে আসি। কতদিন থাকতে হবে এখানে ডাক্তাররা বলতে পারছেন না,' গত বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন এই মা।

শীতের শুরু থেকেই নিউমোনিয়া রোগী বাড়তে থাকায় ১৯ শয্যার এই ওয়ার্ডটি এরই মধ্যে পূর্ণ হয়ে গেছে। হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানান, গত বৃহস্পতিবার ১ হাজার ২০০ রোগীকে বর্হিবিভাগে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে।

চিকিৎসকরা বলেছেন, ঠান্ডাজনিত রোগ বিশেষ করে নিউমোনিয়ার অন্যতম প্রধান কারণ বায়ু দূষণ।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মাহবুবুল হক বলেন, এই হাসপাতালে প্রতিদিনই ঠাণ্ডাজনিত শিশু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এসব রোগে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।

তিনি বলেন, দূষিত বাতাসের সঙ্গে ঠান্ডা আবহাওয়ায় অ্যালার্জিজনিত সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ঘটে বায়ুদূষণের কারণে।

হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসের প্রথম ১১ দিনে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ৭৪ শিশুকে ৬৮১ শয্যার হাসপাতালটিতে ভর্তি করা হয়েছে। গত মাসে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা ছিল ২২৭ জন। অক্টোবর এবং সেপ্টেম্বর মাসে যথাক্রমে ২৯২ এবং ৩৭৮ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল।

গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪ হাজার ১১৮ জন শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৫১১ জন এবং ২০২২ সালে ৩ হাজার ১০৩ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের তথ্য অনুসারে, গত ১৫ নভেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৮৫ হাজার ৪৬৯ জন এবং মারা গেছেন ১৯ জন।

শিশু হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক নাবিলা আকন্দ বলেন, বায়ুদূষণ নিউমোনিয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। শিশুদের শ্বাসতন্ত্র অন্যান্য বয়সের তুলনায় কম বিকশিত হয় এবং শিশুরা বেশিরভাগই বাতাসে আসা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া মাধ্যমে আক্রান্ত হয়।

'বায়ুদূষণ হাঁপানি এবং নিউমোনিয়াসহ অনেক শ্বাসকষ্টজনিত রোগের কারণ। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে এই ধরনের জটিলতায় ভোগা শিশুর সংখ্যা কমবে,' বলেন তিনি।

হাসপাতালের একই ওয়ার্ডে ছয় বছরের বিবি ফাতেমা ২৯ দিন ধরে নিউমোনিয়ার চিকিৎসা নিচ্ছে। তার মা মায়মুনা আক্তার বলেন, 'আমার মেয়ের আগে এই ধরনের তীব্র শ্বাসকষ্ট কখনো হয়নি। শীতকালে সাধারণত সর্দিকাশি থাকত তবে এবার ওর অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে গেছে।'

নরসিংদীর মাধবদীতে যেখানে মায়মুনারা থাকেন সেখানে অনেক জুতা ও পোশাকের কারখানা রয়েছে বলে জানান তিনি।  

চিকিৎসকরা বলেছেন আমার মেয়ের তীব্র শ্বাসকষ্টের কারণ হতে পারে এসব কারখানার দূষিত বাতাস।

অধ্যাপক মাহবুবুল বলেন, 'শিশু হাসপাতালে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা ১০ শতাংশ বেড়েছে।'

আইসিডিডিআর,বি'র তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে শীর্ষ পাঁচটি সংক্রামক রোগের মধ্যে নিউমোনিয়া একটি। সংক্রামক রোগে শূন্য দশমিক ৭ মিলিয়ন মৃত্যুর ১৪ শতাংশ হয়ে থাকে নিউমোনিয়ায়।

আইসিডিডিআর,বির তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি ঘণ্টায় ২-৩ জন শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। প্রতি বছর মারা যায় কমপক্ষে ২৪ হাজার জন।

বৃহস্পতিবার শিশু হাসপাতালের আউটডোর বিভাগে চিকিৎসক দেখানোর জন্য অনেক শিশু ও তাদের অভিভাবকদের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

নয় মাসের শিশুকে নিয়ে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা রামপুরা এলাকার বাসিন্দা সুলতানা আক্তার বলেন, 'আমার মেয়ে গত তিন দিন ধরে জ্বর ও কাশিতে ভুগছে। কাশির কারণে আমি তাকে বুকের দুধ পর্যন্ত খাওয়াতে পারছি না'

লক্ষণ, সতর্কতা

শিশুর মাঝারি বা প্রচণ্ড জ্বর, কাশি এবং দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া—এসব উপসর্গের দিকে চিকিত্সকরা অভিভাবকদের নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। এসব লক্ষণ দেখা গেলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ সুষম খাবার গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। মাস্ক এবং আরামদায়ক গরম কাপড় পরা; এবং ঠান্ডাজনিত রোগের সংক্রমণ রোধে নিয়মিত ব্যায়াম করার পরামর্শ দিয়েছেন।

ডা. নাবিলা আকন্দ ঠাণ্ডা ও দূষিত বাতাসের সংস্পর্শ থেকে শিশুদের রক্ষা করার জন্য অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানান।

প্রয়োজনে শিশুদের মাস্ক পরাতে হবে এবং অতিরিক্ত যত্ন নিতে হবে, বলেন তিনি।

তিনি বলেন, 'বায়ুদূষণের মাত্রা এখন অনেক বেশি। শীতকালে আর্দ্রতা কমে যায়, এবং ধুলিকণার মাত্রা বেড়ে যায়। সেইসঙ্গে নির্মাণকাজ বাতাসের গুণমান আরও খারাপ করে দেয়।'

তিনি বলেন, যাদের অ্যালার্জি আছে তাদের হাঁচি এবং অন্যান্য অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া বেড়ে যায় এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। ধুলাবালির পাশাপাশি ভাইরাসের বিস্তারও তীব্র হয়, ফলে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়।

Comments

The Daily Star  | English

BNP holds meeting with Yunus

Four BNP leaders, led by Khandaker Mosharraf Hossain, reached Yunus' official residence at 7:33pm

1h ago