গণঅভ্যুত্থানের বইমেলার সমালোচনা ও প্রাপ্তি

বইমেলা, ছবি ইমরান মাহফুজ

একুশে বইমেলা শেষের দিকে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমরা ভিন্ন এক বাংলাদেশের যাত্রা নব উদ্যমে শুরু করেছি। নতুন বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা।

শেখ হাসিনা তার ফ্যাসিস্ট শাসনকে দীর্ঘমেয়াদি করতে রবীন্দ্রনাথ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা শিল্প সাহিত্য সবকিছুকে নগ্ন ভাবে ব্যবহার করেছিল। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেক মানুষ ব্যক্তিস্বার্থে, আদর্শের বিভ্রান্তিতে, ইতিহাসের পঠন-পাঠনের দুর্বলতায়  শেখ হাসিনার ক্রীড়নক পরিণত হয়েছিল। 

ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়েছে। হালুয়া রুটির ভাগ পাওয়া শিল্প সাহিত্যের দন্ডমুন্ডের কর্তা সেজে থাকা দোসররা ফ্যাসিস্ট এর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ নতুন বাংলাদেশকে বিতর্কিত করার সকল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারই ফলস্বরূপ তারা মেলা শুরুর বহু আগে থেকেই গুজব ছড়ায় এবারের মেলা আদৌ হবে কিনা?

আমার বাড়ি চট্টগ্রামে। ৯০ শতাংশ মুসলমানের বাংলাদেশে আমাদের বেশির ভাগের জীবনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ কোরান শরীফ। সবচেয়ে আদবের সাথে আমরা কোরান শিখেছিলাম। অবশ্য তাতে অনতিদূরের হিন্দু বাড়িতে গিয়ে টেলিভিশনে বিশ্বকাপ খেলা দেখা, তাদের বাসায় ভাত খাওয়া কোন কিছুই বাধা হয়নি। বাংলাদেশে ইসলামিক সাহিত্যের প্রকাশ ও প্রকাশনার বিস্তৃতি নতুন নয়। চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদকে ঘিরে বইয়ের বিশাল মার্কেটের বড় একটি অংশ জুড়ে ইসলামিক প্রকাশনা ও বইয়ের দোকান বহুদিন ধরে। অথচ গত ১৫ বছর ধরে এইসব প্রকাশনাকেও জঙ্গি তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল।

আপনাদের হয়তো মনে থাকার কথা জঙ্গি ধরার নাম করে মিডিয়ার সামনে যাদের উপস্থাপন করা হতো তাদের বেশিরভাগের সামনে স্বাভাবিক ধর্মীয় পুস্তকগুলো রাখা হতো জঙ্গিবাদের চিহ্নরূপে। ফ্যাসিবাদের দোসরা এই গুজব ছড়িয়েছিল যে এবারের বইমেলা ইসলামিক প্রকাশনীদের বইমেলা হতে যাচ্ছে। বইমেলা এখন শেষ সপ্তাহে। দোসরদের গুজবে তারা ছাড়া কেউ কান দেয়নি। হাজার হাজার মানুষের বইমেলায় আনন্দ বিনোদনের সাথে ঘুরে বেড়ানো বই কেনা তারই প্রমাণ।

বইমেলা স্টল বরাদ্দ নিয়ে পানি কম ঘোলা করার চেষ্টা করা হয়নি। গত ১৫ বছরে ফ্যাসিবাদী বয়ানকে শক্তিশালী করার নামে কোন কোন প্রকাশক কোটি কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাট করেছে। এদের কেউ কেউ স্টলের জন্য আবেদন না করেই গুজব ছড়ায় নামীদামী প্রকাশনীকে স্টল দেয়া হচ্ছে না। আমি বরং দেখলাম যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দায়েরের সুযোগ রয়েছে তাদেরকেও স্টল দেয়া হয়েছে।

গণঅভ্যুত্থানের পরে স্বাভাবিকভাবেই দেশের অর্থনীতি একটি ঝাঁকুনির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। হাজার কোটি টাকা পাচারের ক্ষত নিয়ে চলছে। অনেক প্রকাশক বইপ্রকাশ করার ক্ষেত্রে তাই এবার একটু রক্ষণশীল ভূমিকা নিয়েছে। বই প্রকাশ হয়েছে কম। এর প্রভাব পড়েছে বেচা কেনায়ও। দেশে থাকা ফ্যাসিবাদের  কর্মী সমর্থকরা ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে বইমেলা বয়কট করার ঘোষণাও দেয় । যদিও তাতে সাধারণ মানুষ সাড়া দেয়নি। তবে তারাও তো অল্প স্বল্প বই কিনত। 

বইমেলায় এবার একক কোন বই বিশেষ সাড়া ফেলেনি। তবে গণঅভ্যুত্থানের পর নন ফিকশন বইয়ের প্রতি রাজনৈতিক বইয়ের প্রতি তরুণদের যে আকর্ষণ বেড়েছে তার প্রভাব বই মেলাতেও দেখা গেছে। থ্রিলারধর্মী বইয়ের প্রতি তরুণদের আকর্ষণ এখনো আছে। ইসলামিক বইয়ের স্টলগুলোতেও মানুষের ভিড় দেখা গেছে। 

এটি একটি মেলা। অনেকে বিষয়টি বুঝতে চান না। হাটে মাঠে গ্রামগঞ্জে শহরে বন্দরে মেলাতে যা হয় এখনো তাই হবে। তবে এখানে বইয়ের প্রাধান্য থাকবে। এবারের বইমেলাতেও তাই আছে। তবে পরিচালনাগত ভাবে আরেকটু গোছানো হলে ন্যাপকিন কাণ্ডের মতো ঘটনাগুলো এড়ানো যেত। ধুলোবালিটা কম হতো। বই কেনার আনন্দ আরও বেশি হত বলে মনে হয়।

ও হ্যাঁ বইমেলার কয়েকটি মব বিশৃঙ্খলাকে অভ্যুত্থানের পরে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া রূপেই দেখি। খেয়াল রাখতে হবে দোসররা,ষড়যন্ত্রকারী শক্তি মবের আড়ালে সুযোগ নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে কিনা।

Comments