তালেবান শাসনের ২ বছর: অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে আফগান নারী

তালেবান শাসনের ২ বছর: অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে আফগান নারী
ছবি: রয়টার্স

প্রায় দুই দশক পর ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয় তালেবান। শুরুতে প্রতিশ্রুতি ছিল পূর্বের তুলনায় উদার হবে তারা। নারীদের স্বাধীনতার প্রশ্নে শরিয়া আইন অনুযায়ী পর্দা রক্ষা করে পড়াশোনা ও চাকরির অধিকার থাকবে বলে জানানো হয়েছিল। কিন্তু ২ বছর পর দেখা যাচ্ছে, উল্টো পথে হাঁটছে আফগানিস্তান। সংকুচিত হয়েছে নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অধিকার।

আফগান শিক্ষার্থী জাহরার কাছ থেকে জানা গেল, তার সঙ্গে অনেক মেয়েই স্কুলে পড়ত। তারা একসঙ্গে পড়ত, খেলত, এমনকি মোটরবাইকেও উঠতে পারত।

তবে সেসব এখন সুদূর অতীত। ২০ বছরের জাহরা এখন আর কলেজে যান না, বাইকেও চড়তে পারেন না। সহপাঠীদের কেউ কেউ দেশ ছেড়ে গেছেন। ঘরবন্দি জাহরার সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। এসব ভেবে মানসিক কষ্টে দিন কাটছে তার।

প্রায় ২০ বছরের যুদ্ধ শেষে ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে যুক্তরাষ্ট্র। সরকারে আসীন হওয়া তালেবান দিনটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছে। সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তালেবানদের সহযোগী মুখপাত্র বিল্লাল কারিমি এদিনটিকে 'আফগানিস্তানের জন্য সম্মান ও গৌরবের দিন' বলে অভিহিত করেন।

তার মতে, এদিন বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে মুক্ত হয়েছে আফগানিস্তান। আফগানরাই ঠিক করবে তাদের সরকার, আফগানদের ইচ্ছাতেই চলবে দেশ, বজায় থাকবে সার্বভৌমত্ব।

বিল্লাল মনে করেন, বেশিরভাগ দেশ যেহেতু আফগানিস্তান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি, তাই তাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেলে সমাধান আসতে পারে। বলপ্রয়োগ কোনো সমাধান নয় বলেই তিনি মনে করেন।

কিন্তু প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবের রয়েছে ফারাক। জাহরার মতো বহু নারীর শিক্ষার সুযোগ হয়েছে সংকুচিত। এর ফলে অনেক বিদেশি সংস্থার সাহায্য থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে আফগানিস্তান। সেখানে ক্ষুধা, দারিদ্র‍্যের সঙ্গে নিত্য লড়াই করছে মানুষ।

নারীর অধিকার প্রশ্নে কঠোর রক্ষণশীল অবস্থান বিদেশে তালেবান সরকারের ভাবমূর্তিকে খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে। এ বছর নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য মনোনীত মানবাধিকারকর্মী মাহবুবা সিরাজ মনে করেন, আফগানিস্তানে নারী স্বাধীনতা বলতে আর কিছুই নেই। তার মতে, 'সমাজ থেকেই ধীরে ধীরে মুছে দেওয়া হচ্ছে নারীদের। তাদের মতপ্রকাশ, তাদের কথা, চিন্তা সবকিছুই মুছে দেওয়া হচ্ছে।'

২০ বছর পর ক্ষমতায় আসীন হয়ে নারীদের পর্দা রক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়তে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছিল তালেবান। কিন্তু এখন অবস্থা এমন যে, নারীদের হাইস্কুল পর্যায়ের শিক্ষার সুযোগ 'নেই' হয়ে গেছে। নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, চাকরি, এনজিওর কাজ—সবকিছুতেও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে তালেবান। কোনো পুরুষ মাহরাম ছাড়া চলাচলেও এসেছে নিষেধাজ্ঞা। পার্ক কিংবা জিমের মতো জায়গায় তাদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

গত মাসে আফগানিস্তানের সব পার্লার ও বিউটি সেলুন বন্ধ করেছে তালেবান। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অন্তত ৬০ হাজার নারী। এদের অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। ফলে অনটন ও সংকট বেড়েই চলেছে তাদের।

পড়ালেখার অধিকার হারিয়ে জাহরার মতো অনেকেরই দিন কাটছে ঘরে বসে, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। জাহরা সময় কাটাচ্ছেন ঘরে বসে ছবি এঁকে, বই পড়ে। যতটুকু সম্ভব অনলাইনে ক্লাস করতে চেষ্টা করছেন।

আফগান নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কথাও গত মাসে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কয়েদখানার মতো বন্দি জীবন বাড়িয়েছে মানসিক চাপ। হতাশা আর অবসাদে ভুগছেন অনেক নারী।

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের অন্তত ৮ ভাগ জানান, তাদের পরিচিত কোনো না কোনো নারী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। পারিবারিক নির্যাতন বাড়ছে বলেও জানাচ্ছে এই সমীক্ষা। জোর করে বিয়ে করানো হচ্ছে।

তালেবানদের অন্যতম মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদের দাবি, নারীদের নিরপত্তার জন্য এসব করা হচ্ছে। তার মতে, ইসলামি আইন অনুযায়ী তারা নারীদের জন্য নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতে কাজ করছেন।

তিনি জোর দিয়ে বলেন, 'নারীরা এখন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুলিশ বিভাগ, পাসপোর্ট অফিস, বিমানবন্দরসহ বহু জায়গায় কাজ করছেন।'

তবে কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, বাস্তব অবস্থা মোটেও তেমন নয়। তালেবান শাসনে একজন নারী কেবলমাত্র অন্য কোনো নারীর কাছ থেকেই স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারেন। নারীদের উচ্চশিক্ষায় বাধা দেওয়ার ফলে নারী চিকিৎসক তৈরি অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে নারী ডাক্তার-নার্স পাওয়ার পথ কার্যত বন্ধ হয়ে পড়ছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নারী অধিকার বিভাগের সহপরিচালক হেথার বার এর মতে, 'তালেবানের এমন নীতির ফলে তাদের চোখের সামনে অনেক নারী অসুস্থ হয়ে পড়ছে, মারাও যাচ্ছে।'

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এ নিয়ে কঠোর সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছে তালেবান। জাতিসংঘের তরফে বলা হয়েছে নারী বিষয়ক নীতিতে পরিবর্তন আনতে। তবে তাতে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। ফলে বহির্বিশ্ব থেকে তেমন কোনো সহায়তা পাচ্ছে না আফগানিস্তান।

মাহবুবা সিরাজ যেমন বলছেন, 'আফগান তরুণীরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছেন, বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন।'

তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার ফলে আফগানিস্তানে বৈদেশিক রিজার্ভ কমেছে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। দেশটি হয়ে পড়েছে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর।  হাজারো সরকারি কর্মচারীর বেতন বন্ধ হয়েছে।

আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোতে নারীদের কাজে তালেবানের নিষেধাজ্ঞার ফলে আন্তর্জাতিক সাহায্য আসার পথ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বিরোধিতার পরও তালেবানের এসব কার্যকলাপ স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা আফগানদের। হেথার বার বলছেন, 'তারা নানা দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে হাস্যজ্জ্বল ছবি তুলছেন, উচ্চ পর্যায়ের মিটিংয়ে অংশ নিতে প্রাইভেট জেট বিমানে চড়ছেন, লাল গালিচা সংবর্ধনা পাচ্ছেন। তারা বহু দেশে দূতাবাস খোলার অনুমতিও পেয়েছেন। তাদের দিক থেকে দেখলে তারা কিন্তু ভালোই আছেন।'

২০২১ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৬ লাখ আফগান দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এর ভেতর অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে বসবাসের অনুমতি চাইছেন। আবার যাদেরকে বাধ্য হয়ে আফগানিস্তানে ফিরতে হয়েছে, তাদের থাকতে হচ্ছে আত্মগোপনে।

মাহবুবা সিরাজের ভাষ্য, 'আমি আফগানিস্তানে আছি আমার বোনদের পাশে থাকবার জন্য। আমি এখনো আশা হারাইনি। তবে আশা ধরে রাখাটা প্রতিনিয়ত কঠিন হয়ে পড়ছে।'

জাহরা মনে করেন এখন একটি পথই খোলা আছে। সেটি হলো দেশত্যাগ। তার কথায়, 'সবাই অবশ্যই নিজের দেশেই থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু এখানে থাকার উপায় নেই। আমাকে ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। সেজন্য সবচেয়ে ভালো হয় দেশ ছেড়ে গেলে।'

 

তথ্যসূত্র: সিএনএন, বিবিসি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

Comments

The Daily Star  | English

Water lily tug-of-war continues

The Election Commission and National Citizen Party remain locked in a heated debate over the party’s choice of electoral symbol, the water lily -- a dispute that began in June..Despite several exchanges of letters and multiple meetings between NCP and the chief election commissioner, other

44m ago