ঈদ এসেছে, খুশি আসেনি

ছবি: প্রবীর দাশ

আজ ঈদ, তাই না?

আজ ঈদ কিনা এটা নিশ্চিত হতে হলে কারও কাছে জানতে চাইতে হবে। ঈদগাহে কোনো জামাত নেই। অল্প কিছু মানুষ মসজিদে গেছেন ঈদের নামাজ পড়তে। তারাও নামাজ শেষে ঈদের সেই চিরচেনা কোলাকুলি আর হাত মেলাননি। একত্রিত হয়েও যেন আমরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। সারা দিন বাসায় কোনো অতিথি নেই, কেউ কাওকে দেখতে কারও বাসায় যাচ্ছেন না। উদযাপনের পরিসর ছোট হতে হতে নিজের ঘর আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে।

বাচ্চারা ঈদের চাঁদ দেখতে দৌড়ে বাসার ছাদে যায়নি। কোনো হইহুল্লোড় নেই, আতশবাজি নেই, উচ্চস্বরে হর্নের শব্দ নেই, এমনকি বাইরে উদযাপনের কোনো আয়োজনও নেই। বাইরে সব কিছু শান্ত, চারিদিক নিস্তব্ধ। ভিতরে, করোনায় ঘরবন্দি মানবের কাটানো আরও একটা দিন।

ঈদ আমাদের জীবন, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে এতটাই প্রভাব ফেলে যে, এই দিনটার উপলক্ষে সব কিছুই বদলে যায়। দুই ঈদ আর পহেলা বৈশাখে যে ব্যবসা হয় তা দিয়েই দেশের ব্যবসায়ীরা সারা বছর চলার রসদ পেয়ে থাকেন। দুঃখের বিষয়, এই মহামারির মধ্যে পড়ে গেছে পহেলা বৈশাখ এবং ঈদুল ফিতর। ব্যবসায়ীরা পড়েছেন দুরবস্থায়, আমরা জনগণও। ঈদ এসেছে, তবুও আমাদের সবার ভেতরেই এক বিরাট শূন্যতা বিরাজ করছে।

ঈদের খুশি কোথায় গেল?

আমরা কি এবার হাসি মুখ দেখেছি? প্রতি ঈদের আগে, যে হাসি মুখগুলো বাড়ি যায় শত প্রতিকূলতা সয়ে, তাদের দেখেছি? বাস, ট্রেন, লঞ্চ যে যা পায় তাতে উঠেই বাড়ি যায়। এসব ঘরমুখো মানুষের ভিড়ে কিছু কিছু যানবাহন হয়ে ওঠে নরকতুল্য। তবুও সবার চোখে থাকে এক অদ্ভুত প্রশান্তি, থাকে খুশি-বিজয়ের আনন্দ।

৫০ কিলোমিটার লম্বা যানজটে বসে থেকেও তাদের মুখে হাসি থাকে। ঢাকা থেকে বের হওয়ার সময় ১০ কিলোমিটার হেঁটে পার হওয়ার সময়ও তাদের মুখে হাসি থাকে। ১৮ ঘণ্টা ফেরিঘাটে বসে থেকেও তাদের মুখে হাসি থাকে। বাসের টিকিট না পেয়ে ট্রাকে ওঠা মানুষটারও মুখে হাসি থাকে। ঈদ বোনাসের সামান্য যা কিছু টাকা অবশিষ্ট থাকে তা দিয়েই শেষ মুহূর্তের শপিংয়ের চেষ্টা করার সময়ও তাদের মুখে হাসি থাকে। বাড়ি ফেরার পথে চুরি-ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়েও তাদের মুখে হাসি থাকে। নিজের বাড়িতে, নিজের জন্মস্থানে ফেরার পুরো পথেই তাদের মুখে হাসি থাকে। বাড়ি ফিরে প্রতিটি মানুষের সঙ্গে তাদের দেখা হয়। দেখা হয় চায়ের দোকানের সঙ্গে, গাছের ছায়ায় ঘেরা পথের সঙ্গে, চিরচেনা জীর্ণ রিকশাগুলোর সঙ্গে, সেই মিষ্টির দোকান আর নাপিতের সঙ্গে, দেখা হয় বিস্তীর্ণ ধানের জমির উপর দিয়ে উড়ে চলা পাখির সঙ্গে। শৈশবে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোছল করা পুকুর পাড়ে দাঁড়ালেই তাদের মুখে হাসি ফোটে। পেটের টানে যুদ্ধ করতে করতে আবার যান্ত্রিক শহরে এসে কাজে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত স্থায়ী হয় সেই হাসি। সেই হাসি, কোথায় গেল এবার?

ঈদের আগে বাড়ি যাওয়ার জন্য তারা নাড়ির টান অনুভব করে। প্রতি বছরের মতো বিরাট সংখ্যায় না হলেও এবারও অনেক মানুষ গেছেন বাড়ি। তাদের এই যাত্রা আরও বেশি কষ্টকর হয়ে উঠেছে যানবাহন বন্ধ থাকায়। এবার তাদের হেঁটে চলার পথ দীর্ঘতর হয়েছিল। ফেরি বন্ধ রাখায় তাদের ভোগান্তি আরও বাড়ে। এবার তাদের বলা হয়েছিল বাড়ি না যেতে। তাই এবার তারা হাসেনি। তাদের মুখ জুড়ে কেবলই দুশ্চিন্তার কালো মেঘ। সেই মেঘের সঙ্গে ভেসে বেড়ায় উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। ভাবনার পুরোটা জুড়ে একটাই প্রশ্ন, কী হবে আগামীতে? কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য?

ঢাকাবাসী খুব উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করে চাঁদ রাতের জন্য। ঈদের ঘোষণা আসলেই তারা বেরিয়ে পড়ে শেষ মুহূর্তের শপিংয়ে। ফাঁকা ঢাকায় রাতভর ঘুরে আর আড্ডা দিয়ে শেষ রাতে তারা ঘরে ফেরেন। এবার চাঁদ রাত এলো, চলেও গেল। কিন্তু, বাইরে বের হয়েছেন গুটি কয়েক মানুষ। তাও তাদের মুখে হাসি নেই। সারা মুখ জুড়ে ছড়িয়ে আছে কেবল উদ্বেগ। ঈদের কেনাকাটার জন্যও দেখা যায়নি তেমন ভিড়।

কি ধনী, কি গরিব- সবার মুখে হাসি ফোঁটাতে আসে ঈদ। কিন্তু, এবার এমন এক সময় ঈদ এলো যখন কারো মুখে হাসি নেই। শতাব্দীকালে এমন ঈদ দেখেনি কেউ। তবে, এবারের ঈদ সবার স্মৃতিতে অমলিন হয়ে থাকবে। কারণ, ক্ষুদ্র ভাইরাসের এক বাহিনী সবার কাছ থেকে ঈদের খুশি কেড়ে নিয়ে গেছে।

আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের হাসি। জানি না, কতদিনের জন্য।

Comments

The Daily Star  | English

July charter implementation: Commission races against time to find out ways

Consensus Commission has yet to find a viable mechanism to ensure that the proposed constitutional reforms under the July charter will be implemented

9h ago