৯ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ওএমএসের চাল নয়, যেন হাতে পেলেন চাঁদ

৯ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ওএমএসের চাল নয়, যেন হাতে পেলেন চাঁদ
৫ কেজি চাল ও ৫ কেজি আটার জন্য এভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাদের। তবে যারা শুরুর দিকে থাকেন তারাই শুধু আটা পান। বাকীরা শুধু চাল পান। ছবিটি গত সোমবার উত্তরার পাসপোর্ট অফিস এলাকা থেকে তোলা। ছবি: স্টার

খোলা বাজারে (ওএমএস) পণ্য কিনতে ভোর ৫টার দিকে গিয়ে লাইনে দাঁড়ান মাহমুদা আক্তার (ছদ্মনাম)। ততক্ষণে তার সামনে আরও প্রায় শ খানেক নারী দাঁড়িয়ে ছিলেন। পুরুষদের লাইন ছিল আরও দীর্ঘ।

প্রায় ৯ ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে দুপুর ২টার দিকে ৫ কেজি চাল পান মাহমুদা। চাল নয়, যেন চাঁদ হাতে পেয়েছেন। চোখেমুখে ছিল খুশির ঝিলিক।

মাহমুদা ৯ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে যে চাল কিনলেন সেটা বাজার থেকে কিনতে ১০০ টাকা বেশি লাগতো।

উত্তরা পাসপোর্ট অফিস এলাকায় গত সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত ওএমএস ট্রাকের সামনে দাঁড়িয়ে ক্রেতাদের ওএমএসের পণ্য কিনতে দেখেন এই প্রতিবেদক।

তীব্র রোদের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল একটি করে ব্যাগ।

মাহমুদা আাক্তার বলেন, 'ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠে স্বামী ও বাচ্চাদের জন্য খাবার তৈরি করে এখানে চলে আসি। দুপুর পর্যন্ত এখানেই থাকতে হয়। ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ৫ কেজি চাল ও ৪ থেকে ৫ কেজি আটা পাওয়া যায়। কিছু টাকা বাঁচে। এই টাকাই কই পাই বলেন? তাই কষ্ট হলেও লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। জিনিসপত্রের যে দাম, তাতে চলা মুশকিল।'

প্রায় ৯ ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ৫ কেজি চাল পান মাহমুদা। ছবি: স্টার

মাহমুদার ৩ ছেলে-মেয়ে। স্বামী একটি কসমেটিকসের দোকানের ম্যানেজার। বেতন পান ১৫ হাজার টাকা। এই টাকার অর্ধেকের বেশি চলে যায় বাসা ভাড়ায়। বাকি টাকা দিয়ে কোনোমতে চলে তাদের সংসার।

মাহমুদা বলেন, 'ছেলে-মেয়েদেরকে তেমন কিছু খাওয়াতে পারি না। ছোট বাচ্চাটার জন্য দুধ কিনতে হয়। কিন্তু পারি না। খিচুড়ি রান্না করে খাওয়াই। আমরা গরিব মানুষ, কষ্ট হলেও লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতেই হবে।'

মাহমুদার মতো অন্তত ১০ জন নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল শুধু ৫ কেজি চাল ও ৫ কেজি আটার জন্য তাদের সংগ্রামের গল্প। সংসারের কাজ সেরে আসতে হয় ওএমএসের লাইনে দাঁড়ানের জন্য। তাদের কারও স্বামী রিকশাচালক, কেউবা গার্মেন্টসে কাজ করেন, আবার কেউ কেউ স্বল্প টাকায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।

তানিয়া আক্তার বলেন, 'লাইনের প্রথম দিকে থাকতে হলে ভোর ৪টার দিকে আসতে হয়। শুরুর দিকে যারা থাকেন তারা চাল-আটা ২টিই পান। কিন্তু পরে শুধু চাল পাওয়া যায়, আটা পাওয়া যায় না।'

লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন।

পরে অন্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অনেক মধ্যবিত্ত এমনকি এলাকায় নিজেদের বাড়ি আছে এমন মানুষও ওএমএসের লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কেনেন। অনেকে আবার কাজের লোক দিয়ে এখান থেকে চাল সংগ্রহ করেন।

রিকশা চালক মো. রিপন মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি রাত ৩টায় এসে লাইনে দাঁড়াই। চাল তুলে তারপর রিকশা নিয়ে বের হই।'

'আমি যখন রাতে আসি তখন দেখি, অনেকে গাড়ি নিয়ে এসে কাউকে নামিয়ে দিয়ে যান। অনেকে আবার বাড়ির কাজের লোক দিয়ে চাল কেনেন', যোগ করেন তিনি।

পরিচয় না প্রকাশ করা শর্তে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখান থেকে আমার বাসা ৫ কিলোমিটার দূরে। আমার এলাকাতেও চাল-আটা বিক্রি হয়। কিন্তু সেখানে সবাই পরিচিত, লাইনে দাঁড়াতে লজ্জা লাগে। তারা তো আমার পকেটের অবস্থা জানেন না। কাজেই বাধ্য হয়ে এখানে এসে চাল নেই। আমি মূলত ১টার পরে আসি। কারণ তখন পুরুষের লাইন ফাঁকাই থাকে। ৩০ মিনিট লাইনে থাকলেই চাল পাওয়া যায়।'

'ছেলে-মেয়ে পড়াশোনার খরচ মিটিয়ে নিজের সংসার চালাতে আমার প্রায় ৩০ হাজার টাকা লাগে প্রতি মাসে। কিন্তু আয় তো সীমিত। বাজারে ৬০ টাকার নিচে তেমন চাল পাওয়া যায় না। এখানে ৩০ টাকায় পাওয়া যায়। কাজেই বাধ্য হয়ে এখানে আসি। তবে প্রতিদিন আসি না। সপ্তাহে ২ থেকে ৩ দিন আসি', যোগ করেন তিনি।

মধ্যবিত্ত ও বাড়ির মালিকরাও যে লাইনে দাঁড়িয়ে চাল নেন সে কথা জানালেন ওএমএস ট্রাকের তদারকি করা খাদ্য অধিদপ্তরের পরিদর্শকও। তবে তিনি নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি।

এই পরিদর্শক বলেন, 'আমাদের এখানে অনেক মধ্যবিত্ত এবং বাড়ির মালিকও চাল নেন। আমরা বুঝতে পারি। সমস্যায় না থাকলে তো আর ৫ কেজি চাল ও ৫ কেজি আটার জন্য ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতো না। তারা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোটার আইডি কার্ড দেখিয়ে চাল নেন। এখানে আমাদেরও কিছু বলার নেই। অনেকেই লজ্জা পান তাই বোরকা পরে আসেন।'

তিনি জানান, সেখানে সপ্তাহে ৫ দিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চাল ও আটা দেওয়া হয়। প্রতিদিন ২ হাজার কেজি চাল ও ১ হাজার কেজি আটা দেওয়া হয়। প্রত্যেককে সর্বোচ্চ ৫ কেজি চালা ও ৫ কেজি খোলা আটা দেওয়া হয়। তবে যেদিন প্যাকেট আটা দেওয়া হয় সেদিন সর্বোচ্চ ২ প্যাকেট অর্থাৎ ৪ কেজি আটা দেওয়া হয়। প্রতি কেজি চাল বিক্রি হয় ৩০ টাকা এবং আটা ২৪ টাকা। তবে প্যাকেট আটা ২ কেজির দাম ৫৫ টাকা।

বাজারে সবকিছুর দাম বাড়তি। ২ মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ১০০ টাকা, ডিমের দাম ডজন প্রতি বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। গরুর মাংস কেজিতে এলাকা ভেদে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে। বেড়েছে সবজি, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের প্রায় সবকিছুর দাম। এই পরিস্থিতি অনেকেই বাধ্য হয়েছেন খরচ কমাতে। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে তাই অনেকের ভরসা এখন ওএমএসের পণ্য।

Comments

The Daily Star  | English
July uprising and the rise of collective power

July uprising and the rise of collective power

Through this movement, the people of Bangladesh expressed their protest using a language shaped by long-standing discontent.

10h ago