অবহেলায় মধুপুরের আনারস

মধুপুরের আনারস
দেশের উৎপাদিত মোট আনারসের বেশিরভাগ উৎপাদিত হয় মধুপুরে। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

আনারসের রাজধানী হিসেবে সুপরিচিত টাঙ্গাইলের মধুপুর। রসালো, সুমিষ্ট স্বাদ আর চমৎকার ঘ্রাণের জন্য বিখ্যাত এ এলাকার আনারস।

দেশের উৎপাদিত মোট আনারসের সিংহভাগই এখানে উৎপাদিত হলেও, অবহেলা ও সঠিক পরিকল্পনা, পরিচর্যার অভাবে এ এলাকার আনারসের সুনাম হারিয়ে যেতে বসেছে।

স্থানীয় আনারস চাষিরা জানান, ভরা মৌসুমেও ক্রেতা স্বল্পতার কারণে আনারস কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। কারণ সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় বাগান থেকে তুলে বাজারে নেওয়ার পর সেগুলো আর ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না।

তারা জানান, এবার সারের দাম বৃদ্ধিসহ কিছু কারণে আনারস চাষের খরচ অনেক বেড়েছে। কিন্তু বিক্রি করতে হচ্ছে গত বছরের চেয়ে অনেক কম দামে।

মধুপুরের প্রধান বাজার জলছত্রে সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অল্প কয়েকজন পাইকার আনারস কিনতে এসেছেন।

দাম কমার কারণ হিসেবে তাদের দাবি, আগের মতো আর আনারস কিনছে না মানুষ। বিক্রি কমার কারণ হিসেবে তারা অর্থনৈতিক মন্দা, আমসহ আরও কয়েকটি গ্রীষ্মকালীন ফল একইসঙ্গে বাজারে থাকার কথা জানান।

এছাড়া, আনারসে রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে ক্রেতাদের অনাগ্রহের কথাও উল্লেখ করেন পাইকাররা।

মধুপুরের আনারস
মধুপুরের জলছত্রে আনারসের বড় বাজার বসলেও ক্রেতা হাতেগোনা কয়েকজন। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

জানা যায়, মধুপুরের আউশনারা ইউনিয়নের ইদিলপুর গ্রামের গারো ভেরেনো সাংমা ষাটের দশকে ভারতের মেঘালয় থেকে জায়ান্ট কিউ জাতের কিছু চারা এনে প্রথমবারের মতো মধুপুর গড়ে আনারস চাষ শুরু করেন।

এরপর আশপাশের কয়েকটি উপজেলাসহ প্রায় ১০ হাজার হেক্টরে এখন আনারস চাষ হচ্ছে।

স্থানীয় কৃষি বিভাগের দাবি, বছরে প্রায় ২ লাখ টন আনারস উৎপাদিত হয় এ অঞ্চলে।

জুলাই-আগস্ট এ ২ মাস আনারসের মৌসুম ধরা হলেও, এখন প্রায় সারাবছরই মধুপুরের আনারস পাওয়া যায়। এখানে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয় জায়ান্ট কিউ জাতের আনারস, যা এখানকার চাষিদের কাছে ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত।

এছাড়া হানি কুইন (স্থানীয় নাম জলডুঙ্গি) ও আশ্বিনা জাতের আনারস চাষ হয় এখানে। সম্প্রতি ফিলিপাইনের এমডি-২ জাতের আনারসের নামও এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

চাষিরা জানান, ফলের আকার বড় করতে স্থানীয় কীটনাশক ডিলারদের কাছ থেকে হরমোন কিনে ব্যাবহার করা হয়। পরে ভালো দাম পেতে রাসায়নিক দিয়ে অল্প অল্প করে আনারস পাকিয়ে বাজারে নেওয়া হয়।

তাদের মতে, বৃষ্টির কারণে সব ফল একসঙ্গে পেকে গেলে সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় নষ্টের আশঙ্কা থাকে।

জলছত্রের আনারস চাষি গণেশ সাহা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত বছর যে ফল ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, সেটি এ বছর ৩০-৩৫ টাকার বেশি দিয়ে নিতে চাচ্ছে না পাইকাররা। কারণ হিসেবে বলছে চাহিদা কম।'

বগুড়ার শাজাহানপুরের পাইকার জাহাঙ্গীর হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মানুষ এবার আনারসের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এদিকে পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে। তাই লোকসান এড়াতে এবার কম ফল কিনছি।'

তিনি বলেন, 'আগে যেখানে ৩ দিনে ৫ হাজার আনারস বিক্রি করতে পারতাম, এখন ১৫০০-১৮০০টির বেশি বিক্রি করতে পারছি না।'

আনারস ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম বলেন, 'বিভিন্ন কোম্পানির প্ররোচনায় আনারস বড় করতে ও পাকাতে রাসায়নিক ব্যবহার করছে অনেক কৃষক।'

তিনি জানান, গ্রোথ হরমোন ব্যবহারে আনারসের আকার বড় হলেও ভেতরে ফাঁপা ও পানসে হয়ে যায়। তাছাড়া ফল আরও বড় করার আশায় কৃষক অতিরিক্ত হরমোন ব্যবহার করে।

এছাড়া, পাকানোর জন্য রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে কয়েকদিনের মধ্যে আনারস হলুদ রং হয়ে যায়।

ঘাটাইল উপজেলা জলছত্র বাজারে আনারস কিনতে আসা ব্যাংকার সুমন আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি আনারস খুবই পছন্দ করি। কিন্তু রাসায়নিকের ভয়ে এখন খুব একটা কিনি না।'

মধুপুরে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ আনারস পচনের হাত থেকে রক্ষা করতে এ এলাকায় একটি জুস বা খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপনের দাবি চাষিদের।

তারা বলছেন, কৃষকরা বিক্রির নিশ্চয়তা আর ন্যায্য দাম পেলে আনারসে রাসায়নিক ব্যবহার করবে না। এমন উদ্যোগ নেওয়া হলে মধুপুরের আনারস বিদেশে রপ্তানিও সম্ভব।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh investment to GDP ratio 2025

Private investment sinks to five-year low

Private investment as a percentage of the gross domestic product has slumped to its lowest level in five years, stoking fears over waning business confidence and a slowdown in job creation.

11h ago