ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে

'এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?'—আধুনিক ধারার জনপ্রিয় একটি গান। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা এই গানটিতে প্রেম, প্রকৃতি, আকাঙ্ক্ষা উঠে এসেছে। ১৯৬১ সালে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত 'সপ্তপদী' চলচ্চিত্রের মাধ্যমে গানটি সবার সামনে আসে। এর সুর করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং গেয়েছেন তিনি ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

ষাটের দশকের শুরুতে লেখা গানটি আজও মানুষের মুখে মুখে রয়েছে। ভালোবাসার দুজন মানুষের হারিয়ে যাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা রয়েছে গানের সুরে, তা আজও কমেনি যেন একবিন্দু।

সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে না লিখে যদি আজ ঢাকা শহরে কোথাও যাওয়ার সময় গাড়িতে বসে গানটি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের মাথায় আসত, তবে গানটি কেমন হতো? তিনি হয়তো লিখতেন, 'এই পথ যদি দ্রুত শেষ হয়, তবে দারুণ হতো তুমি জানো তো?'

কারণ গত ২ দিন ধরে ঢাকা শহরে যানজট তীব্র হয়ে উঠেছে। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, এই যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিসগামী যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন সবচেয়ে বেশি। অফিসের এক ঘণ্টা আগে বাসা থেকে বের হয়ে আরও ২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও অফিসে পৌঁছাতে পারছেন না। অনলাইনে ক্লাস শেষে দীর্ঘদিন পর স্কুলে গিয়ে ক্লাস করার যে সুযোগ, প্রথম দিনে অনেকেই তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কারণ সড়কেই দুটো ক্লাসের সময় শেষ হয়েছে।

সেইসঙ্গে বাসের ভেতরে ফাগুনের আগুনঝরা গরমে ঘেমে-নেয়ে বিরক্ত মানুষ। ত্যক্ত-বিরক্ত যাত্রীরা কেউ কেউ হেঁটেও গন্তব্যে রওনা দিয়েছেন। অনেকে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়েছেন বাসের সিটে। আর ঘুমের রাজ্যে খুব দ্রুতই পৌঁছে গেছেন গন্তব্যে। কিন্তু ২ ঘণ্টা পর ঘুম ভেঙে দেখেন, কিসের কী! যথাস্থানে বাস না থাকলেও খুব বেশি দূরও যায়নি, মাঝখানে গরমে গায়ের কাপড় ভিজে একাকার। অবশ্য এই অবস্থায় গৌরীপ্রসন্ন থাকলে প্রেমের গানটি কোনদিকে মোড় নিত, সেটা বড়ই ভাবনার বিষয়!

এই শহরের যানজট অবশ্য নতুন নয়। বছরের পর বছর ধরে রাজধানীবাসী যানজটে নাকাল। অতীতে এমন উদাহরণও রয়েছে, যানজটের কারণে যথাসময়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে না পারায় অ্যাম্বুলেন্সেই মৃত্যু হয়েছে রোগীর। হাসপাতালে ডাক্তার প্রস্তুত থাকলেও রোগী পৌঁছাতে না পারায় মৃত্যু। এর চেয়ে ভয়াবহতা আর কী হতে পারে। কিন্তু সেই ভয়াবহতা নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো কেউ নেই।

অবশ্য এয়ার কন্ডিশনের গাড়িতে বসে সড়কে নামলে মাথা না ঘামানোই তো স্বাভাবিক। যারা দায়িত্বে রয়েছেন, তারা যদি যাত্রীবাহী বাসে উঠে গন্তব্যে যেতেন, তাহলে তারা শুধু মাথা ঘামাতেনই না সঙ্গে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতেন নিশ্চয়ই। কারণ এতে তাদের মাথা ছাড়াও আরও অনেক কিছু ঘামত!

হঠাৎ হঠাৎ অবশ্য অমাবশ্যার চাঁদ দেখার মতো যাত্রীবাহী বাসে ফাটাকেষ্ট স্টাইলে মন্ত্রী বা মেয়রকে দেখা যায়। আর দেশের গণমাধ্যমগুলোও ঝাঁপিয়ে পড়ে। সংবাদ হয়। চারদিকে বাহ্ বাহ্ রব ওঠে। কী অবাক করা ব্যাপার—দেশের একজন মন্ত্রী বা মেয়র বাসে উঠেছেন! মুহূর্তেই যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় ভিডিও, সহমত ভাইয়েরা তা ছড়িয়ে দেন ফেসবুকের আনাচে-কানাচে।

কিন্তু এসব করে কি-ই বা লাভ হয়েছে যোগাযোগ খাতে, যানজট কতটা কমেছে কিংবা যাত্রীবাহী বাসে যাতায়াত সুবিধা কতটা বেড়েছে, তা অবশ্য অনেকেরই বোধগম্য নয়। কিছু বুঝতে না পারলেও মুখ খুলে কেউ তা বলতে সাহস পান না। কারণ কিছু বললেই আবার চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, যা বেষ্টনী আকারে নিজেদের চারপাশে গেড়ে দেওয়া হয়েছে।

এই বিশাল নিরাপত্তার চাদরে বসে ক্ষমতাসীনরা অনেক কিছু করতে পারলেও বিপরীত মতের কেউ কিছু করলে বা সমালোচনা করলেই খেল খতম! স্পর্শকাতর সহমত ভাইরা তখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে হাজির হন থানায়। কিন্তু বিয়ে না করেও শ্বশুর বাড়ি যেতে কেই-বা রাজি হবেন। কাজেই যা চলছে চলুক না। তারচেয়ে বরং যানজটে অমাবশ্যার চাঁদের ভিডিও দেখতে দেখতে প্রশংসার বুলি আওড়ানোই এখন সবচেয়ে উপযুক্ত।

যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে একটু শরীরই তো ঘামছে। একটু সময়ই তো নষ্ট হচ্ছে, জীবন তো আর যাচ্ছে না! বরং তীব্র যানজটে গাড়িতে বসে বা দাঁড়িয়ে যে সময়টুকু হাওয়া হচ্ছে, তা কাজে লাগানো যায় কি-না, এমন চিন্তা করা উচিত।

যানজটের কারণে কর্মঘণ্টা নষ্ট, আর্থিক ক্ষতি, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়া ছাড়া কিছু ভালো দিকও রয়েছে। সেসব নিয়েও আলোচনা করা যায়। বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে না নিয়ে কীভাবে ইতিবাচক করা যায়, তা একটু ভেবে দেখা যেতে পারে। যেমন—অনেকেই বাসায় ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না, তারা অফিসে যাওয়ার সময় ২ ঘণ্টা এবং বাসায় ফেরার সময় ২ ঘণ্টা কাজে লাগাতে পারেন। ৪ ঘণ্টা যদি বাসেই ঘুমানো যায়, তাহলে বাসায় মাত্র ২ ঘণ্টা ঘুমালেই রাতের বাকি সময়টা অন্য কোনো কাজে ব্যয় করা যাবে অনায়াসে।

ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে বাসে উঠতে পারেন, তাহলে পাশাপাশি থাকলে নিশ্চয়ই মন্দ লাগবে না (এ ক্ষেত্রে অবশ্য গৌরীপ্রসন্নের 'এই পথ যদি না শেষ হয়' গানটি মিলে যাবে!)। দীর্ঘসময় এক জায়গায় থাকতে থাকতে যদি দুপুর গড়িয়ে যায়, যদি ক্ষুধায় পেটে হাহাকার চলে, তবুও কোনো সমস্যা নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে সহজেই অনলাইনে খাবার অর্ডার করতে পারেন। শিক্ষার্থীরাও দারুণভাবে কাজে লাগাতে পারেন সময়। এ ক্ষেত্রে পড়াশোনার কাজটা এগিয়ে নিতে পারেন।

চাকরিপ্রার্থীরা বাসে বসে বসে পড়াশোনার পর যদি ভবিষ্যতে কোনো চাকরি পেয়ে যান, তাহলে গণমাধ্যমে সংবাদ হয়ে যেতে পারেন। যেমন—যানজটের সময়কে কাজে লাগিয়ে আজ বিসিএস উত্তীর্ণ! এমন সংবাদে নিজেকে দেখতে এখনই বাসে বই নিয়ে বসা যেতে পারে। সময়কে কাজে লাগানো যেতে পারে।

আবার যানজটে আটকে কিন্তু সৃষ্টিশীল কোনো কাজও হতে পারে। ব্যস্ত জীবনে যারা সময়ের অভাবে লেখালেখি করতে পারেন না, তারা কিন্তু যানজটে বসে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, এমনকি নিয়মিত চর্চা করলে মহাকাব্যও রচনা করতে পারেন!

আজকে যদি ঢাকা শহরে ঘুরতে এসে বাইরে বের হতেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাহলে তিনিও হয়তো কোনো কবিতা রচনা করতেন। শিলাইদহ বসে ১৯০০ সালের ২ জুন (২০ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৭) বর্ষার কোনো এক সময় আকাশ দেখে তিনি লিখেছিলেন, 'নীল নবঘনে, আষাঢ় গগনে, তিল ঠাঁই আর নাহিরে/ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে'।

আর আজকের ঢাকার যানজট দেখে কবিগুরু হয়তো লিখতেন—

ঢাকা শহরে যানজট সড়কে, চাকা আর নাহি চলে রে

ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে!

ছোট-বড় গাড়ি সারি সারি, থমকে রয়েছে, যায় না তো ছাড়ি

বসে বসে যাত্রীদের জীবনে আঁধার ঘনিয়েছে, দেখ চাহি রে

ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে!

তানজিল রিমন: সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
inside story of the attack on Daily Star office

Inside a coordinated assault on The Daily Star

Reporter recounts how vandalism, smoke, and security threats shut down the newsroom

6h ago