বিশ্লেষণ

এবারের ভোটে নতুন চ্যালেঞ্জ ‘সময়’

ইলাস্ট্রেশন: আনোয়ার সোহেল/স্টার

নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক মক ভোটিং যেন উন্মোচন করল এক অদৃশ্য সংকট—ভোটাধিকার প্রয়োগে প্রতিটি নাগরিক কতটা সময় পাবেন, তা হয়ে উঠেছে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে এক নিঃশব্দ লড়াই।

নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেছেন—এই সংকট আসন্ন নির্বাচনে বড় ধরনের লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। কারণ এবারই প্রথম একই দিনে ভোটারদের দুটি ব্যালট দিতে হবে—একটি সংসদ নির্বাচনের জন্য এবং আরেকটি গণভোটের জন্য।

গণতন্ত্রের যুগসন্ধিক্ষণে দুটি ভোটই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সংসদ নির্বাচন দেশের গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার পথ নির্দেশ করবে, আর গণভোট নির্ধারণ করবে—জুলাই সনদ গৃহীত সেই সংস্কার চুক্তি, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ও সংস্কার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, টিকে থাকবে কি না।

২৯ নভেম্বরের মক ভোটিংয়ের তথ্য বলছে—দুটি ভোট দিতে গিয়ে সময় বেশ বেড়ে যাচ্ছে। সানাউল্লাহ জানান, একজন ভোটার গড়ে ৩ মিনিট ৫২ সেকেন্ড নিচ্ছেন। যারা ব্যালট না পড়ে সরাসরি ভোট দেন, তাদের লাগে প্রায় ২ মিনিট। আর যারা ব্যালট পড়ে বুঝে সিদ্ধান্ত নেন, তাদের লাগে ৭ থেকে ৮ মিনিট।

সময় বেশি লাগাও স্বাভাবিক। গণভোটের প্রশ্নে প্রায় ১৮৫টি শব্দ আছে। এতে আইনগত ও সাংবিধানিক জটিল ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলো চারটি মূল পয়েন্ট নিয়ে লেখা।

একজন শিক্ষিত ভোটারের জন্যও গণভোটের ব্যালট সহজ নয়। দ্রুত পড়াও কঠিন। শুধু পড়তেই দুই মিনিট লেগে যেতে পারে। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া ও সিল মারার সময় তো আছেই।

সমস্যা শুধু ব্যালট লম্বা বলেই নয়, এর ভাষা এবং বিষয়বস্তুও অনেকের কাছে অপরিচিত। যিনি সাংবিধানিক সংস্কার বিষয়ে আগে থেকেই জানেন, তিনি দ্রুত পড়তে পারবেন। আর যিনি প্রথমবার দেখছেন, স্বাভাবিকভাবেই তার বেশি সময় লাগবে।

নির্বাচন কমিশন ভোটের সময় গোনে ভোটার বুথে প্রবেশ করার মুহূর্ত থেকে। তালিকা দেখে নাম যাচাই, ব্যালট নেওয়া, গোপন কক্ষে যাওয়া, সিল দেওয়া, ব্যালট বাক্সে ফেলা এবং বুথ থেকে বের হওয়া—সব ধাপই এতে অন্তর্ভুক্ত।

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে কমিশন তার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। দেশে থাকবে মোট ৪২ হাজার ৭৬১টি কেন্দ্র এবং ২ লাখ ৪৪ হাজার ৭৩৯টি বুথ। প্রতিটি কেন্দ্রে প্রায় তিন হাজার ভোটারের ভোট প্রাদনের ব্যবস্থা থাকবে। প্রতি ৬০০ পুরুষ ভোটারের জন্য একটি বুথ এবং প্রতি ৫০০ নারী ভোটারের জন্য একটি বুথ বরাদ্দ থাকবে। মোট ভোটার হবে ১২.৭৬ কোটি।

ভোটের সময়ও এক ঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে। আগের মতো সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা নয়, এবার ভোট হবে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। সাড়ে ৪টার পর কেন্দ্রের ভেতরে যারা থাকবেন, তারা ভোট দিতে পারবেন, কিন্তু নতুন ভোটারকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। পাশাপাশি, যেখানে সম্ভব বেশি সংখ্যক গোপন কক্ষ বসানো হবে।

এখন হিসাব করি। একটি পুরুষ বুথে ৬০০ এবং একটি নারী বুথে ৫০০ ভোটার থাকলে প্রত্যেকে যথাক্রমে মাত্র ৫৪ এবং ৬৫ সেকেন্ড সময় পান। কিন্তু মক ভোটিংয়ে দেখা গেছে—একজনের লাগছে ৭ থেকে ৮ মিনিট। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় সময়ের তুলনায় আট গুণ বেশি। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই ভোট দিতে পারবেন না। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে অনেকে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। এতে ভোটার অংশগ্রহণ কমে যাবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটাররা তিনটি ব্যালটে ভোট দেন, কিন্তু সেসব বুথে ভোটারের সংখ্যাও কম থাকে। সেক্ষেত্রে পুরুষদের প্রতি জনে ৭২ সেকেন্ড এবং নারীদের ৮২ সেকেন্ড সময় ধরে পরিকল্পনা করা হয়। তারা পরিচিত প্রতীক, পরিচিত ব্যবস্থা—সবকিছু আগেই জানেন।

কিন্তু এবার গণভোট সম্পর্কে মানুষের জানাশোনা কম, ফলে সময় লাগছে বেশি।

সহজেই অনুমান করা যায়, এই নির্বাচনে প্রত্যেক ভোটারের সময় বেশি লাগবেই। এতে বড় ধরনের পরিচালনাগত চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। লাইনে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। বিশেষ করে নারী, বয়স্ক ও অসুস্থদের জন্য ঝক্কি বেশি। অনেকেই ভোট না দিয়েই চলে যেতে পারেন। ফলে উপস্থিতি কমে যাবে,  নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে পড়বে। ধীরগতির লাইন অনিয়মের গুজবও বাড়ায়, যা আস্থার সংকট তৈরি করতে পারে।

যদি কেন্দ্র সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব না হয়, তবে অন্তত বুথ এবং গোপন কক্ষ বাড়ানো জরুরি। এতে প্রতি বুথের ওপর চাপ কমবে, লাইনও দ্রুত এগোবে।

এর পাশাপাশি ভোটারদের সচেতন করাটাও অত্যন্ত জরুরি। নির্বাচন কমিশন এখনই দুটি ব্যালটে কীভাবে ভোট দিতে হয়, তা নিয়ে প্রচার শুরু করতে পারে। গণভোটের নমুনা ব্যালট অনলাইনে, মোবাইল অ্যাপে ও গ্রামেগঞ্জে প্রচারের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছানো যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং কমিউনিটি সংগঠনগুলোতে মক ভোটিংয়ের আয়োজন করাও কার্যকর হতে পারে।

পরিচিতি সবসময়ই সাহায্য করে। যিনি আগে থেকে ব্যালট সম্পর্কে জানবেন, তিনি কম দ্বিধায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। বয়স, শিক্ষা, ও ব্যালটের জটিলতা পড়ার গতিকে প্রভাবিত করে। তবে প্রস্তুতি সবসময় আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।

ভোটার যত বেশি জেনে বুথে ঢুকবেন, ভোটের প্রক্রিয়া ততই সহজ, দ্রুত ও কার্যকর হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Citing security concerns, N'ganj-5 BNP candidate withdraws from election race

He was asked to withdraw over poor grassroots engagement, says city BNP convener

2h ago