ইতিহাসের নীরব সাক্ষী তিতাসপাড়ের হরিপুর জমিদার বাড়ি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার হরিণবেড় গ্রাম। সেখানে বয়ে চলা তিতাস নদীর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে হরিপুর জমিদার বাড়ি। 'বড়বাড়ি' বা 'রাজবাড়ি' নামে পরিচিত মোগল আমলের প্রাচীন এই স্থাপনাটি ছিল জমিদার পরিবারের রাজকীয় আচার-অনুষ্ঠান আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। আজ সেই রাজকীয়তা হারিয়ে গেছে, ক্ষয়ে গেছে পুরোনো সেই রূপ।
দূর থেকে এই বাড়ি মনোমুগ্ধকরই লাগে। তবে কাছে গেলে চোখে পড়ে ভাঙাচোরা ফটক, সময়ের দাগে ছেঁড়া বারান্দা আর ধুলা-শ্যাওলা জমা কার্নিশ।
২০১৮ সালে সরকার এ স্থাপনাটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে ঘোষণা করে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জমিদার গৌরীপ্রসাদ ও কৃষ্ণপ্রসাদ রায় চৌধুরী ১৮৪৩ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেন।
পাঁচ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা প্রাসাদটিতে একসময় প্রায় ৬০টি কক্ষ ছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল দরবার হল, সঙ্গীতালয়, নৃত্যাগার, কোষাগার, স্নানঘাট ও খেলাঘর। ইট, চুন ও দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি এই স্থাপনায় একটিও লোহার রড ব্যবহার করা হয়নি।
বাড়িটির পশ্চিম পাশে তিতাস নদীর ধারে জমিদার পত্নী উমা রানি রায় চৌধুরীর স্মরণে নির্মিত শান বাঁধানো ঘাট রয়েছে। পাশে দুটি মন্দিরও রয়েছে। একসময় নৌকায় আগত অতিথিদের স্বাগত জানানো হতো এখানে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য একাডেমির সভাপতি ও কবি জয়দুল হোসেন বলেন, 'প্রতিটি খিলান যেন ভুলে যাওয়া এক পংক্তি, প্রতিটি বারান্দা হারিয়ে যাওয়া বাংলার ইতিহাসের অংশ।'
ধারণা করা হয়, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর জমিদার পরিবার কলকাতায় চলে গেলে প্রাসাদটির ক্ষয় হতে শুরু করে। পরে এটি অর্পিত সম্পত্তি আইনের আওতায় চলে যায়। যদিও কিছু পুরোহিত ও জমিদারের বংশধররা প্রাসাদটিকে রক্ষণাবেক্ষণের চেষ্টা করেন, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটি ধ্বংসপ্রায় হয়ে যায়।
হরিপুরের জমিদার পরিবারটি ভারতের ত্রিপুরার একটি প্রভাবশালী জমিদার পরিবারের উত্তরসূরী। বাড়িটির ২০১৬ সালে শুরু হওয়া সংস্কারকাজ ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। বারান্দা, মন্দির, ছাদ ও ঘাটের অনেক অংশ ইতোমধ্যে সংস্কার হয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ফিল্ড অফিসার মো. সাঈদ ইনাম তানভীরুল বলেন, 'পুরোপুরি অ-ধাতব উপকরণে তৈরি এমন স্থাপনা পূর্ব বাংলায় বিরল। মোগল নকশা এবং উপনিবেশিক সুনিপুণতার এক অনন্য সংমিশ্রণ এতে স্পষ্ট।'
স্থানীয়রা মনে করেন, যথাযথ সংরক্ষণ ও পর্যটন সুযোগ তৈরি হলে হরিপুর বড়বাড়ি শুধু ইতিহাসই নয়, এলাকার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রাণশক্তি হয়ে উঠতে পারে। জেলার প্রশাসন ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরও পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরের কর্মপরিকল্পনায় এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কুমিল্লা আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নাহিদ সুলতানা জানান, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের কর্মপরিকল্পনায় হরিপুর জমিদার বাড়ির পূর্ণাঙ্গ সংস্কার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বরাদ্দের ওপর নির্ভর করবে কাজের পরিধি।
২০২৩ সালে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সিদ্ধান্তের পর তৎকালীন জেলা প্রশাসক শাহগীর আলম বাড়িটিকে দখলমুক্ত করেন। সেখানে বসবাসরত পরিবারগুলোকে সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে স্থানান্তর করেন।
নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহীনা নাছরিন বলেন, 'উপজেলা প্রশাসন অনিয়মিত দখল থেকে প্রাসাদটি মুক্ত করেছে। এখন আমরা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে সংস্কারকাজ এগিয়ে নিচ্ছি।'
জেলা প্রশাসন জানায়, খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ ২০১২ সালে 'ঘেটুপুত্র কমলা' চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের জন্য এই জমিদার বাড়িকে বেছে নেন। এর আগে ১৯৯১ সালে 'মধু মালতী', ২০০১ সালে 'নাইয়রী' এবং ২০০৮ সালে যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার 'দ্য লাস্ট ঠাকুর' চলচ্চিত্রের শুটিংও হয় এখানেই।
জমিদার বাড়িটির নিরাপত্তায় থাকা আনসার সদস্যরা জানান, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এটি দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। বর্ষাকালে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা রাখা হয়। নদীপথে এসে অনেকে নৌকায় গান-বাজনা ও পিকনিক করেন এই বাড়িতে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা ও ইতিহাস গবেষক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বপন বলেন, 'বর্ষায় বাড়িটির অন্য রূপ দেখা যায়। নদী যখন উপচে পড়ে এবং বাড়ির প্রতিচ্ছবি ধরে রাখে, তখন মনে হয় প্রাসাদটি নিজেকে আবার মনে করার চেষ্টা করছে।'
তবে আবাসিক হোটেল বা খাবারের ব্যবস্থা না থাকায় দূরদূরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের ভোগান্তিতে পড়তে হয় বলে জানান স্থানীয়রা। তাদের মতে, যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে হরিপুর বড়বাড়িকে ঘিরে পর্যটন শিল্প বিকশিত হতে পারে।
জমিদার বাড়ি দেখতে আসা কলেজছাত্রী তাবাসসুম আক্তার বলেন, 'বাড়িটির নকশা ও অলংকরণ খুব সুন্দর, কিন্তু ভেতরের অবস্থা খারাপ। দ্রুত সংস্কার হলে আরও অনেক পর্যটক এখানে আসবে।'
স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সঞ্জয় দেব বলেন, 'জমিদার বাড়িটি সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এ ধরনের প্রচেষ্টা তরুণ প্রজন্মকে আমাদের অতীতের সঙ্গে সংযোগ করতে এবং এর সাংস্কৃতিক মূল্য বোঝার সুযোগ দেবে।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, 'এই প্রাসাদের অসীম সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা এটি পুনর্নির্মাণ এবং সংরক্ষণের প্রস্তাব সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছি। পুনর্গঠনের বিষয়ে আমরা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করব।'
কীভাবে যাবেন
যদিও বাড়িটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থিত, এর অবস্থান হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার কাছাকাছি। রাজধানী ঢাকা থেকে আসা পর্যটকরা সিলেটগামী বাসে চেপে মাধবপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে সেখান থেকে পশ্চিম দিকে সিএনজি বা অটোরিকশায় হরিপুর বড়বাড়ি যেতে পারবেন।
এছাড়া কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সিলেটগামী পারাবত এক্সপ্রেস ট্রেনে হবিগঞ্জের নয়োপাড়া স্টেশনে নেমে সেখান থেকে রিজার্ভ অটোরিকশায় মাধবপুর হয়ে হরিপুরে যাওয়া যায়।


Comments