আম শুকিয়েই বাজিমাত
চাঁপাইনবাবগঞ্জের মুঞ্জের আলমের বাগান থেকে আসা আমের প্রায় এক চতুর্থাংশ প্রতিবছর বাজারে পৌঁছানোর আগেই পচে নষ্ট হয়ে যেত। এই লোকসান থেকে বাঁচার পথ খুঁজছিলেন তিনি। সেই সমাধান মিলেছে ফল শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণে।
তবে প্রচলিত জুস বা পাল্প তৈরির পথে হাঁটেননি তিনি। মুঞ্জের দেখলেন শুকিয়ে (ডিহাইড্রেট) গুঁড়া করা ফলের বাজারে চাহিদা আছে। এই উদ্ভাবন তার ব্যবসার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এতে যেমন অপচয় কমেছে বরং শুকনো আম ও ফলের গুঁড়া বিক্রি করে নিয়মিত আয় রোজগারের স্বপ্ন দেখছেন। শুধু আম নয়, মুঞ্জের এখন পেয়ারা ও কাঁঠালও শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করছেন।
মুঞ্জের আলম বলেন, 'নিজের বাগানের ফসল নষ্ট হতে দেখাটা ছিল খুব হতাশাজনক। প্রক্রিয়াজাতকরণ শেখার পর বুঝলাম, এই ফলগুলো দিয়েই আয় করা সম্ভব।'
মুঞ্জেরের ৩০ বিঘা বাগানে প্রতি মৌসুমে প্রায় ৮০ টন আম হয়। আগে এর ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশই পচে নষ্ট হতো। এখন সেই অপচয় ১০ শতাংশ কমেছে।
আম অত্যন্ত পচনশীল একটি ফল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্যমতে, দেশে বছরে আম উৎপাদিত হয় প্রায় ২৭ লাখ টন, যার এক-চতুর্থাংশই সঠিক উপায়ে সংরক্ষণের অভাবে ভোক্তার হাতে পৌছানোর আগেই নষ্ট হয়ে যায়।
মুঞ্জের ২০২২ সালে আমের গুঁড়া নিয়ে পরীক্ষা শুরু করেন। ২০২৪ সালে শুকনো আম নিয়ে বাণিজ্যিক উদ্যোগে কাজ শুরু করেন। তবে জাপানি একটি কোম্পানির কারিগরি সহায়তায় ২০২৫ সালে এসে তিনি সাফল্য পান।
বাজারে এখন শুকনো আম প্রতি কেজি ২,০০০ থেকে ২,৪০০ টাকায় এবং আমের গুঁড়া ১,২০০ থেকে ১,৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই উদ্যোক্তা জানান, এতে তার লাভ থাকছে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ।
গত মৌসুমে তিনি ৭০০ কেজি শুকনো আম ও ১০০ কেজি আমের গুঁড়া বিক্রি করেছেন। আগামী মৌসুমে তার লক্ষ্য ২০ হাজার কেজি শুকনো আম ও ৫ হাজার কেজি গুঁড়া বিক্রি করা। এর পাশাপাশি শুকনো পেয়ারা ও কাঁঠালের উৎপাদনও বাড়াচ্ছেন তিনি।
চোখ এখন রপ্তানিতে
দেশীয় বাজারে বিক্রির পাশাপাশি মুঞ্জের এখন রপ্তানির সুযোগ খুঁজছেন। তিনি বলেন, 'ইংল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার ক্রেতাদের সঙ্গে কথা চলছে। কোনো কিছুই এখনো চূড়ান্ত হয়নি, তবে বিশেষ করে শুকনো আমের প্রতি তাদের আগ্রহ আছে। আশা করছি, শিগগিরই ১০ হাজার কেজির একটি রপ্তানি আদেশ পাব।'
মুঞ্জের বিশ্বাস করেন, শুকনো ফল নিয়ে বাংলাদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসার সুযোগ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, শুকনো আমের বৈশ্বিক বাজারের আকার ২.২৪ বিলিয়ন ডলারের। আর আম-ভিত্তিক প্রক্রিয়াজাত পণ্যের বাজার ২৫ বিলিয়ন ডলারের। বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম আম উৎপাদনকারী দেশ হয়েও এই বাজারে বাংলাদেশের কোনো হিস্যা নেই বললেই চলে।
মুঞ্জের ২০১৪ সালে যখন প্রথম উদ্যোগ নেন তখন তিনি একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করতেন। চাকরির পাশাপাশি ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রা শুরু করেন তিনি। প্রথমে সবজি, পেয়ারা, আম, ড্রাগন ফল, ধান ও সরিষা দিয়ে শুরু করেছিলেন। ২০২৫ সাল নাগাদ তার ব্যবসার আকার তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। শুধু ফল শুকানোর কাজেই তিনি বিনিয়োগ করেছেন প্রায় এক কোটি টাকা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান বলেন, ফসলের অপচয় কমাতে বিশ্বের অনেক দেশই কাজ করছে। ফল প্রক্রিয়াজাত করে দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণ এর একটি ভালো উপায়।
তিনি আরও বলেন, 'তবে এসব পণ্য বাজারজাত করার আগে অবশ্যই ভোক্তার জন্য এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, উদ্যোক্তারা শুরুতেই এসব পণ্য নিয়ে গ্রহণযোগ্যতা হারাতে পারেন।'
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো প্রতি বছর 'শত শত কোটি' টাকার আমের গুঁড়া আমদানি করে। এই বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার দেশীয় কৃষক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সহজেই ধরতে পারেন।
মুঞ্জেরের হিসাবে, শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের বাজারই ৭ হাজার কোটি টাকার। আশপাশের জেলাগুলোকে হিসাবে নিলে প্রক্রিয়াজাত ফল থেকেই ২২ হাজার কোটি টাকার শিল্প গড়ে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি সম্ভব।


Comments