এখন থেকে সব সরকারি ক্রয় হবে ই-জিপির মাধ্যমেই

ছবি: সংগৃহীত

দুর্নীতি দমন ও ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে অনলাইনের মাধ্যমে সব ধরনের সরকারি ক্রয় শুরু করেছে সরকার। এর মাধ্যমে কাগজে টেন্ডার জমা দেওয়ার দীর্ঘদিনের প্রথার অবসান হলো।

নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, এখন থেকে বছরে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য, সেবা ও কাজের সব ক্রয় ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট বা ই-জিপি সিস্টেমের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে।

২০২৫ সালের সরকারি ক্রয়বিধিতে দীর্ঘদিনের বিতর্কিত মূল্যসীমাও তুলে দেওয়া হয়েছে। এই মূল্যসীমা অনুযায়ী, পণ্য বা সেবার প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে একজন ঠিকাদার সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বেশি বা কম দর দেওয়ার সুযোগ পেতেন। তারচেয়ে বেশি বা কম হলে সেই দর বাতিল হতো। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই বিধান কাজে লাগিয়ে কারসাজি করা হতো।

২০১১ সালে সরকারি ক্রয়ের জন্য ই-জিপি সিস্টেম চালু হয়। তবে বাংলাদেশ সরকারি ক্রয় কর্তৃপক্ষের (বিপিপিএ) তথ্য মতে, সরকারের বার্ষিক ক্রয়ের প্রায় ৩৫ শতাংশ এখনো কাগজের টেন্ডারের মাধ্যমে সম্পন্ন হতো।

নতুন সরকারি ক্রয়বিধিতে (পিপিআর) ছোট পরিসরের ক্রয়ের ক্ষেত্রেও হাতে হাতে বা সরাসরি ক্রয়ের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।

সরকারি ক্রয় কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী এস এম মঈন উদ্দিন এই সংস্কারকে একটি মাইলফলক হিসেবে অভিহিত করেছেন।

তিনি বলেন, 'সরকারি ক্রয়বিধি-২০২৫ শুধুই একটি সংশোধন নয়; এটা সামগ্রিক সংস্কার—যেখানে টেকসই উন্নয়ন, ডিজিটালাইজেশন ও আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে ভালো পদ্ধতিতে ক্রয় প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।'

নতুন আইনে ক্রয়ের দায়িত্বগুলোর স্পষ্ট সংজ্ঞা, সরলীকৃত প্রক্রিয়া এবং অনিয়ম মোকাবিলা ও সিন্ডিকেট বন্ধে আরও শক্তিশালী জবাবদিহির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এতে চুক্তির মূল্য নির্ধারণ, ত্রুটির দায়বদ্ধতা ও টেকসই মানদণ্ড নিয়ে বিস্তারিত নিয়ম করা হয়েছে এবং চুক্তি করার সময় প্রকৃত মালিকানা প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

প্রথমবারের মতো নিরাপত্তা বা রক্ষণাবেক্ষণের মতো সেবাগুলোকে আলাদা ক্রয়শ্রেণি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অন্যান্য বড় সংস্কারের মধ্যে রয়েছে ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির বিস্তৃত ব্যবহার, অপরাধীদের কালো তালিকাভুক্ত করার জন্য একটি নিষেধাজ্ঞা বোর্ড গঠন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রিতে কঠোর নির্দেশিকা।

কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন বিধিতে টেকসই সরকারি ক্রয়ের বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে, যেখানে সরকারি ব্যয়ের সিদ্ধান্তে পরিবেশগত ও সামাজিক দায়িত্ব বিবেচনায় নেওয়া হবে। এখন থেকে ক্রয়কারী সংস্থাগুলোকে ক্রয় শুরু করার আগে কৌশলগত নথি প্রস্তুত করতে হবে।

বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব মো. কামাল উদ্দিন এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, 'সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় অগ্রগতি।'

অর্থনীতিবিদ ও সুশাসন বিশেষজ্ঞরাও নতুন সরকারি ক্রয় আইনের প্রশংসা করেছেন।

দক্ষিণ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান মূল্যসীমা বাতিল ও বাধ্যতামূলক ই-জিপি ব্যবস্থাকে উল্লেখ করেছেন 'প্রভাব খাটানো ও রাজনৈতিক প্রভাবের সুযোগ তৈরি করা পুরনো প্রথা থেকে সম্পূর্ণ সরে আসা'র ব্যবস্থা হিসেবে।

তিনি স্বাধীন পর্যবেক্ষণ, কর্মক্ষমতা নিরীক্ষা ও মন্ত্রণালয়গুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে মত দেন, যাতে আইনের প্রয়োগে ধারাবাহিকতা নিশ্চিত হয়।

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মসরুর রিয়াজ বলেছেন, নতুন এই বিধি 'পক্ষপাতিত্ব, রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্রয়ে অদক্ষতা থেকে সরে আসার ইঙ্গিত'।

তিনি প্রকৃত মালিকানা প্রকাশ ও টেকসই নীতিমালা অন্তর্ভুক্তিকে একটি বড় উদ্যোগ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি বলেছেন, সংস্কার কার্যকর করতে মন্ত্রণালয়গুলোর আরও বেশি প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক সক্ষমতা প্রয়োজন হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, সংস্কারগুলো অবশ্যই সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

তিনি বলেন, 'সমতার বিষয়টিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই প্রক্রিয়ার ভেতরেই কিছু ধাপ আছে, যা কাগুজে নিয়ন্ত্রণকে রেখেই দেবে এবং উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার যে প্রচেষ্টা, তাকে বাধাগ্রস্ত করবে।'

তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ দুর্বলভাবে নকশা করা হলে বা বেছে বেছে প্রয়োগ করা হলে এখনো ফাঁকফোকর কাজে লাগানো সম্ভব।

কিছু বিধান প্রত্যাহার করা হলে কারসাজির সুযোগ কমবে এবং সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হবে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক যোগ করেন, 'সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।'

Comments