অজেয় অজিতেশ: মঞ্চই ছিল যার প্রাণ

অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় তখনো 'অজিতেশ' হননি। কলেজের খাতায় নামটা তখনো অজিতই। তবে কলকাতায় এসে নামটা বদলে ফেললেন। কারণ, তখন এই নামেই কলকাতায় আরেকজন পরিচিত মঞ্চ অভিনেতা ছিলেন।
কলকাতায় তার শিক্ষক ধীরেন ঘটক প্রথম রবীন্দ্রনাথের 'খ্যাতির বিড়ম্বনা' নাটকে তাকে 'কড়ি' চরিত্রে অভিনয় করান। ধীরে ধীরে অজিতেশের ভালোবাসা জন্মে অভিনয়ের প্রতি। কলকাতার মহারাজা মণীন্দ্র মোহন কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পড়তেন তিনি। সে সময়ই বাম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। দীক্ষিত হন মার্কসবাদে। যোগ দেন 'গণনাট্য সংঘে'।
অজিতেশ ঠিক করেন নাটক নিয়ে গ্রামে গ্রামে যাবেন। গণনাট্য সংঘের হয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে যেতে থাকেন নাটক নিয়ে। অজিতেশের স্বপ্ন ছিলো 'রাজনৈতিক থিয়েটার' করার। এই থিয়েটার সুনির্দিষ্ট কোনো পার্টির পক্ষে কাজ করবে না, বরং কাজ করবে মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার জন্য। অজিতেশ বিশ্বাস করতেন, সবকিছু 'পার্টিজান' না হতে পারে, কিন্তু সবকিছুই রাজনৈতিক। খনিশ্রমিক পিতার সন্তান অজিতেশ নিজের জীবন থেকেই বুঝেছিলেন বঞ্চনার বেদনা। তাই শোষণমুক্তির জন্য নাটককেই করতে চাইলেন আশ্রয়।
তবে তার সেই ইচ্ছা পূরণ হলো না। পার্টির ভেতরের নানারকম প্রতিবন্ধকতা নিয়ে অস্বস্তি ছিল, এর ভেতর গণনাট্য থেকে বেরিয়ে তিনি ও অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়সহ আরও কয়েকজন মিলে করলেন নান্দীকার। সেটা ১৯৬০ সালের কথা। এরপর সেখানে যোগ দেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, বিভাস চক্রবর্তী, কেয়া চক্রবর্তীসহ আরও অনেকে।
এরপর অজিতেশের নাট্যপ্রতিভার স্ফূরণ ঘটতে থাকল ব্যাপক মাত্রায়। পাশ্চাত্যের নাটকগুলোকে তিনি বাংলায় রূপান্তর করলেন, কিন্তু কাহিনীগুলোকে নিয়ে এলেন ভারতের প্রেক্ষাপটে। যেমন: তার প্রিয় লেখক আন্তন চেখভের 'চেরি অরচার্ড' থেকে করলেন 'মঞ্জরী আমের মঞ্জরী', 'সোয়ান সং' থেকে করলেন 'নানা রংয়ের দিন', 'প্রোপোজাল' থেকে করলেন 'প্রস্তাব'। বার্টল্ট ব্রেখটের 'দ্য থ্রিপেনি অপেরা' থেকে করলেন 'তিন পয়সার পালা'। সফোক্লিসের 'আন্তিগোনে'ও মঞ্চস্থ করলেন।
তবে পুরোপুরি পাশ্চাত্যে না থেকে তিনি নাটকগুলোকে স্থাপন করলেন ভারতের প্রেক্ষাপটে। 'তিন পয়সার পালা' নাটকে ঝাড়খন্ডের একসেন্টে সমালোচনা করা হলো সামন্তবাদের। 'মঞ্জরী আমের মঞ্জরী'-তেও তিনি তুলে ধরলেন তার পারিপার্শ্বিক ও সমাজের কাপুরুষতা। 'আন্তিগোনে'-কেও তিনি গ্রিকের বদলে করে তুললেন ভারতীয়৷ এখানে ক্রেয়ন চরিত্রে কেয়া চক্রবর্তীর অবিস্মরণীয় অভিনয় ও 'আন্তিগোনে' অজিতেশের সঙ্গে মঞ্চের দ্বৈরথ দর্শককে শিহরিত করেছিল।
অজিতেশ অচিরেই শম্ভু মিত্র ও উৎপল দত্তের পাশাপাশি আরেকজন খ্যাতিমান নাট্যকারে পরিণত হলেন। শম্ভুর পুরোপুরি পাশ্চাত্য ধাঁচের ও উৎপলের পুরোপুরি দেশীয় কাজের মাঝামাঝি এসে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে মিলিয়ে দিলেন অজিতেশ।

তবে গণনাট্য ছাড়লেও পার্টি কিন্তু তখনো ছাড়েননি তিনি। প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসুদের সঙ্গে তখন সিপিআই করেন তিনি। কিন্তু ১৯৬৪ সালে ছেড়ে দিলেন সিপিআই। পার্টি তখনো ভাগ হয়নি। তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় শিল্পীদের ব্যবহার করা নিয়ে প্রমোদ দাশগুপ্তের সঙ্গে মনোমালিন্য হলো তার। প্রমোদ দাশগুপ্ত চেয়েছিলেন থিয়েটারের শিল্পীরা ভোটের আগে পার্টির পক্ষে পথনাটক করুক। কিন্তু অজিতেশ সরাসরি প্রমোদ দাশগুপ্তকে বলেছিলেন যে, তিনি ওভাবে অতুল্য ঘোষ সেজে বা মাথায় গান্ধীটুপি পরে কংগ্রেসকে ব্যঙ্গ করে পথনাটক করতে পারবেন না। এই ধরনের পোস্টার প্লেতে কোনো লাভ হয় না। প্রমোদ জানিয়ে দিয়েছিলেন, পার্টিতে যিনি যে কাজটা করায় দক্ষ, তিনি সেই কাজ করার মাধ্যমে পার্টিকে যদি সাহায্য না করেন, তবে তিনি বিশ্বাসঘাতক। অজিতেশ এই কথার প্রতিবাদ করেছিলেন। বলেছিলেন, ভোটের আগে এসব নাটক করে কোনো লাভ হয় না। কেন সারা বছর এই ধরনের নাটক নিয়ে গিয়ে জনমত গঠনের চেষ্টা করা হয় না?
অজিতেশ পার্টি ছেড়ে দিলেন। পুরোপুরি নাটক নিয়েই থাকলেন। পরে এ প্রসঙ্গে তার এক লেখায় লিখেছিলেন, 'আমি তখন পুরোদস্তুর কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং দায়িত্ববান সদস্য। আমি লক্ষ্য করেছি—যারা পার্টির সদস্যপদ নেন, তারা পার্টির সুবিধাগুলো ভোগ করেন, কষ্টগুলো নয়। পার্টির গর্বগুলো, লজ্জাগুলো নয়। তাদেরকে বলা হত "মোর দ্যান অ্যা পার্টি মেম্বার"। এ নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যেও বহুবার ঠাট্টা করেছি।'
অজিতেশ সে সময়ে কোলকাতার বিখ্যাত সাউথ পয়েন্ট স্কুলে ইংরেজি সাহিত্য পড়াতেন। এর ভেতরই প্রস্তাব এলো তপন সিংহের তরফ থেকে। অশোক কুমারকে নিয়ে তিনি করছেন 'হাটে-বাজারে'। অজিতেশকে ভিলেন 'লছমনলাল'-এর চরিত্রে ভাবছেন। অজিতেশের চরিত্রটি পছন্দ হলো। রাজি হলেন। তবে তার এ-ও মনে হলো, তার ছাত্ররা বয়সে ছোট। তাকে এই রোলে দেখে খারাপ মানুষ মনে করতে পারে! তাই স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দিলেন।
'হাটে-বাজারে' মুক্তির পর অজিতেশের নাম তখন সবার মুখে মুখে। এরপর বেছে বেছে সিনেমায় অভিনয় করতে থাকলেন, তবে মঞ্চই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। 'মঞ্জরী আমের মঞ্জরী', 'তিন পয়সার পালা', 'শের আফগান', 'ফুটবল ফুটবল'—এর মতো নাটকগুলো এতই সফল হয় যে, টিকিটের জন্য লম্বা লাইন পড়ে যেত। 'শের আফগান' বাংলা নাটকের ইতিহাসেও আলাদা ধরনের একটি কাজ ছিল। অজিতেশের অনন্য অভিনয় নাটকটিকে তুমুল জনপ্রিয় করে।
এর ভেতরই এলো আরেক ঝড়। নান্দীকারের ভেতরে নানা কারণে দ্বন্দ্ব। প্রথমে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় দল ছাড়লেন। ১৯৭৭ সালে ছাড়লেন অজিতেশ। সে বছরই এক দুর্ঘটনায় পানিতে ডুবে মারা গেলেন কেয়া চক্রবর্তী।
অজিতেশ গড়ে তুললেন নতুন দল 'নান্দীমুখ।' সেই দলও পেল তুমুল জনপ্রিয়তা। এর পাশপাশি সিনেমাতেও অভিনয় চলছিল। 'কুহেলি' (১৯৭১), 'ঠগিনী' (১৯৭৪), 'গণদেবতা' (১৯৭৮)-র মতো সিনেমায় তার অবিস্মরণীয় অভিনয় আজো দর্শককে বিস্মিত করে।

অজিতেশ এ সময়ে যাত্রাতেও নাম লেখান। গণমানুষের এই শিল্পটি নিয়ে বেশ আগ্রহ ছিল তার। এ ব্যাপারে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'অর্থের জন্য যাত্রায় এসেছি, প্রাথমিকভাবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাছাড়া গ্রামের ছেলে তো, ছেলেবেলা কেটেছে কোলিয়ারি এলাকায়। সেই সময় অনেক যাত্রা দেখেছি। তাই একবার এই মাধ্যমে অভিনয় করার খুব লোভ হলো।'
থিয়েটার-যাত্রা সিনেমা নিয়ে অজিতেশ তখন অনেক ব্যস্ত। মাথায় তার অনেক পরিকল্পনা, অনেক স্বপ্ন। এর ভেতরই ঘটে গেল সেই ঘটনাটা। দিনটি ছিল ১৯৮৩ সালের ১২ অক্টোবর। দুর্গাপূজার সপ্তমী সেদিন। 'এই অরণ্যে' নাটকের শো করে এসে রাত ১১টায় সস্ত্রীক অজিতেশ বাড়ি ফেরেন। তার প্রিয় সাদা রুটি আর পাঁঠার মাংস খান। এরপর বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। পরদিন শো নেই। বুকটা একটু একটু ব্যথা করছিল। তেমন গুরুত্ব দেননি, ভেবেছিলেন গ্যাসের ব্যথা। এরপর রাত গভীর হতেই ব্যথাটা বাড়ে। পাড়ার ছেলেরা ডাক্তার ডেকে আনে। প্রায় পাঁচ-ছয়জন ডাক্তার আসেন। তবে ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গিয়েছে।
১৯৩৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় চলে যান ১৯৮৩ সালের ১২ অক্টোবর দিনগত রাত পৌনে দুইটার (১৩ অক্টোবর) দিকে। মাত্র ৫০ বছর বয়সেই থেমে যায় তার জীবন। বাংলা থিয়েটারের জন্য এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।
বাংলা নাটককে বহুভাবে ঋদ্ধ-সমৃদ্ধ করলেও যে 'রাজনৈতিক থিয়েটার'-এর স্বপ্ন দেখেছিলেন অজিতেশ, তা সেভাবে পূরণ হয়নি। এ ব্যাপারে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 'আমাদের এখানে রাজনৈতিক থিয়েটারের নামে যা হয়, তা আসলে ওই রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে একটু মস্করা করলাম বা পুলিশকে একটা কমিক কারেক্টার বানিয়ে ব্যঙ্গ করলাম অথবা এস্টাব্লিশমেন্টের বিরুদ্ধে কিছু বললাম। ব্যস এই পর্যন্তই। তাছাড়া এখানে ভোটের আগে রাজনৈতিক দলগুলো কিছু নাট্যদলকে ভোটের স্বার্থে কিছু রাজনীতির কথা নাটকের মাধ্যমে বলিয়ে নিল। এর বেশি কিছু নয়। রাজনৈতিক থিয়েটার বলে এখানে আলাদা করে কিছু গড়ে ওঠেনি। অর্থাৎ নাটকে শিকড় থেকে উঠে আসা কোনো কথা বা বিষয়, তা আমরা এখনো সেই অর্থে পাইনি।'
Comments