গানের আড়ালে এক ভবঘুরে বিদ্রোহী কবি

গানের আড়ালে এক ভবঘুরে বিদ্রোহী কবি
জিম মরিসন। ছবি: সংগৃহীত

জিম মরিসন শুধু 'দ্য ডোরস' ব্যান্ডের গায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক কবি, এক ভবঘুরে, এক বিদ্রোহী। মঞ্চে তার উপস্থিতি ছিল দারুণ শক্তিশালী, কখনো ভয়ানক, কখনো মায়াবী। ভিড়ের শ্রোতা-দর্শকদের চোখে তিনি ছিলেন রক তারকা। কিন্তু বাইরে থেকে যা দেখা যায়, তার ভেতর লুকিয়ে ছিল আরও গভীর এক মানুষের প্রতিচ্ছবি। তার কবিতা, লেখা এবং গানের লিরিক্স—সবই তার অন্তরের জগতকে প্রকাশ করত।

মরিসনের কবিতা যেন তার আত্মার প্রতিবিম্ব। এখানে ঘটেছে মানুষ, মৃত্যু, প্রেম ও শূন্যতার মিলন। শব্দগুলো কখনো সরল নয়। তারা ঘন রূপকে মোড়া, আবেগপূর্ণ এবং এক ধরনের অমোঘ সৌন্দর্যে ভরা। কবিতা পড়লে বোঝা যায়, মরিসন কখনো স্থির থাকতে পারতেন না। জীবন তার কাছে ছিল এক অবিরাম পরীক্ষা, যেখানে সীমা ভাঙা এবং অনুভূতি যাচাই করাই ছিল তার কাজ।

শব্দে জন্ম নেওয়া বিদ্রোহ

মরিসনের লেখা প্রায়শই ভগ্নাংশের মতো; অর্থাৎ লাইনগুলো আলাদা হলেও একসঙ্গে একটি দৃশ্য তৈরি করে। 'চেইনড সনস অব দ্য মুন' কবিতায় তিনি লিখেছেন,

'আই সি মাইসেলফ ইন অ্যা ভিশন অব অ্যানাদার টাইম
হোয়্যার দ্য উইন্ড হুইসপারস সিক্রেটস নো ওয়ান আন্ডার্স্ট্যান্ডস।'

এই লাইনগুলোতে আমরা পাই তার নিঃসঙ্গতার প্রতিচ্ছবি। শব্দগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, পাঠক অনুভব করে—একটি মানুষ তার ভেতরের ভাঙন, আকাঙ্ক্ষা ও অস্থিরতার সঙ্গে লড়ছে।

মরিসনের কবিতার প্রধান পুনরাবৃত্ত বিষয়গুলো হলো—মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা, প্রেম, শারীরিক ও মানসিক সীমা পরীক্ষা। তিনি মানুষ, সমাজ, প্রেম—সবকিছুকে তরল এবং পরিবর্তনশীল হিসেবে দেখতেন। মৃত্যুর প্রতীক, যৌনতা ও নেশা—সবই নতুন অর্থ পায় তার লেখায়। ধ্বংস কেবল ধ্বংস নয়; এটি নতুন উপলব্ধি দেয়। কবিতা শেখায়, ব্যথা অনুভব করা যায় এবং তা থেকে শিল্প তৈরি করা যায়।

নিঃসঙ্গতা এবং ভেতরের যন্ত্রণা

'চেইনড সনস অব দ্য মুন'-এ তিনি লিখেছেন,

'দ্য নাইট কলস মাই নেম
অ্যান্ড আই অ্যানসার উইথ শ্যাডোওস।'

রাত তার এক ধরনের বন্ধু। এখানে তিনি তার গভীরতম ভয় ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন। কবিতা শুধুই শব্দ নয়; এটি অনুভূতির এক ভ্রমণ। পাঠক নিজেকে খুঁজে পায় তার শব্দে।

মরিসনের নিঃসঙ্গতা ছিল অব্যক্ত, কিন্তু প্রকাশ পেত তার লেখায়। শব্দের ছন্দ, তাল ও চিত্র পাঠককে ভেতরের জগতে নিয়ে যায়। তার কবিতা কখনো বিশৃঙ্খল মনে হলেও 'ডেলিবারেট', অর্থাৎ মনোযোগ দিয়ে তৈরি—যেন ইম্প্রোভাইজ করা কোনো পারফরম্যান্স।

গানের আড়ালে এক ভবঘুরে বিদ্রোহী কবি
'দ্য ডোরস' এর সদস্যদের সঙ্গে জিম। ছবি: সংগৃহীত

মৃত্যু, নেশা ও প্রেম

মরিসনের জীবন ও কবিতা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। তার লেখা প্রায়ই গভীর রোমান্টিকতা ও অন্ধকারের সংমিশ্রণ ধারণ করে। মৃত্যুর ও নেশার উপাদান তার কবিতার একটি প্রধান 'রিকারিং মোটিফ'।

'ওয়্যারলেস অব সাইলেন্স'-এ তিনি লিখেছেন:

'আই ড্রিংক দ্য নাইট অ্যান্ড শ্যালো দ্য স্টারস,
ইয়েট দ্য এম্পটিনেস রিমেইনস।'

এই লাইনগুলোতে বোঝা যায়, জীবন তার কাছে কখনো পূর্ণতা পায়নি। ব্যথা ও শূন্যতা ছিল তার অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। প্রেমের আকাঙ্ক্ষা, আত্মবিনাশ ও অস্তিত্বগত অস্থিরতা—সব মিলিয়ে তার কবিতার গভীরতা তৈরি হয়েছে।

মরিসন দেখিয়েছেন, মৃত্যুর ধারণা তার লেখা ও জীবন—উভয়কেই ছুঁয়ে রেখেছে। নেশা কেবল পদার্থ নয়; এটি ছিল তার অনুভূতির পরীক্ষা, যা তাকে নিঃসঙ্গতা ও অস্তিত্বের সীমায় নিয়ে যায়। প্রেমের দিকে তার দৃষ্টি কখনো সরল নয়; এটি জটিল, কখনো বেদনাদায়ক, কখনো উত্তেজনাপূর্ণ। তিনি দেখিয়েছেন, প্রেমের অনুভূতি মানুষের আত্মাকে ভেঙে দিতে পারে, কিন্তু সেই ভাঙনের মধ্য থেকেই শিল্প এবং উপলব্ধি জন্মায়।

কবিতা, গান ও সিনেমাটিক চিত্র

মরিসনের কবিতা ও গান একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়। 'দ্য অ্যান্ড' বা 'রাইডার্স অন দ্য স্টর্ম'-এ মৃত্যু, প্রেম, নিঃসঙ্গতা—সবই শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তার কবিতার নিরীক্ষাধর্মী গঠন পাঠককে গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন আত্মিক এক যাত্রায় নিয়ে যায়।

সিনেমাটিকভাবে ভাবলে, জিম বসে আছেন এক অন্ধকার ঘরে। ছায়া ও আলো মিশে রহস্য তৈরি করছে। হাতে খাতা, মাঝে মাঝে আগুনের ঝলক। বাইরে লস অ্যাঞ্জেলসের আলো, ভিড়, শব্দ। ভেতরে এক নিঃসঙ্গ কবি তার আত্মার মানচিত্র তৈরি করছেন। প্রেম, মৃত্যু, ভয় ও অবসাদ—সবই কবিতার রেখায় অমর।

তার কবিতার ছবি যেন চলমান সিনেমার মতো। লাইনগুলো শোনা যায় ভেতরে, কিন্তু প্রত্যেক শব্দ একটি দৃশ্য তৈরি করে। 'দ্য ওল্ড বটল' বা 'দ্য গর্ডন স্টোরি'-তে শব্দগুলোই পাঠককে শহরের রাস্তায়, অন্ধকারে, হালকা আলোয় ভাসমান করে। কবিতা শুধু অনুভূতি নয়; এটি এক দৃশ্যগত ও মানসিক অভিজ্ঞতা।

গানের আড়ালে এক ভবঘুরে বিদ্রোহী কবি
জিম মরিসন। ছবি: সংগৃহীত

বিদ্রোহের ভেতর মানুষ

মরিসনের কবিতা রাজনৈতিক বা সামাজিক মন্তব্য নয়; বরং মানসিক এবং অন্তর্দৃষ্টি-ভিত্তিক। মানুষের ভেতরের দ্বন্দ্ব, সামাজিক প্রত্যাশা, অস্তিত্বগত অস্থিরতা—সবই তার লেখায় প্রকাশ পায়। ৬০-এর দশকের 'কাউন্টারকালচার'-এর প্রেক্ষাপটে তার লেখা 'রেবেলিয়ন' বা বিদ্রোহের প্রতীক। কিন্তু প্রায়শই তিনি নিজেই অন্তর্গত বিদ্রোহের শিকার।

তিনি চেয়েছিলেন সীমা পরীক্ষা করতে। নাইটক্লাব, পারফরম্যান্স, রোড ট্রিপ—সবই তার কাছে ছিল পরীক্ষা। এই পরীক্ষার মধ্যেই তিনি খুঁজে পেতেন নিজের সত্তা। তার কবিতা এবং সংগীতের মিলন যেন সিনেমাটিক অনুভূতির মতো।

মরিসন দেখিয়েছেন, সত্যিকারের বিদ্রোহ কেবল সমাজের সঙ্গে নয়; এটি ব্যক্তিগত, অন্তর্গত। আত্মার, অনুভূতির ও মনের সীমা পরীক্ষা করা তার শিল্পের মূল। পাঠক কবিতার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায়, যেন সিনেমার চরিত্র নিজের ভেতরের যন্ত্রণার সঙ্গে লড়ছে।

কবিতার অন্তর্গত গান

মরিসনের কবিতার লাইনগুলো কখনো সরল নয়। তারা দেখায়, জীবন জটিল। ব্যথা ও আনন্দ একসঙ্গে প্রবাহিত হয়। 'ব্রেক অন থ্রু (টু দ্য আদার সাইড)'-এ তিনি লিখেছেন:

'পুশ বিয়ন্ড দ্য ওয়ালস,
হোয়্যার নাথিং হোল্ডস,
অ্যান্ড ইউ আর ফ্রি।'

এই লাইনগুলোতে বোঝা যায়, বিদ্রোহ কেবল রাজনৈতিক নয়, এটি ব্যক্তিগত। স্বাধীনতা, নিজের চিন্তা, অনুভূতি—সবই মানুষের ভেতরের যুদ্ধকে চিহ্নিত করে।

মরিসনের গানও কবিতার মতো। তিনি দেখিয়েছেন, শব্দের ধারা, ছন্দ ও তাল কেবল শোনার জন্য নয়; তা পাঠক ও শ্রোতাকে ভেতরের জগতে নিয়ে যায়। প্রতিটি লাইন একটি মানসিক ভ্রমণে পরিণত হয়। মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা, প্রেম, ব্যথা—সবকিছুই তার গানের মধ্যে প্রবাহিত।

চিরকালিক নিঃসঙ্গতা ও দ্রোহ

মরিসনের কবিতা চিরকালই নিঃসঙ্গতাকে স্বীকৃতি দেয়। ব্যথা সুন্দর হতে পারে। বিদ্রোহ মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করে। শিল্পের মাধ্যমে তিনি শেখান, সীমা পরীক্ষা করা যায়। শূন্যতা অনুভব করা যায়।

১৯৭১ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে মরিসন চলে যান। তার মৃত্যু নিয়ে কিছু রহস্য রয়েছে আজও। কিন্তু তার কবিতা, গান এবং 'পারসোনা' চিরকাল আমাদের মনে দাগ রেখে যাবে। মানুষের অন্তর যতই বিভক্ত হোক না কেন, শিল্প এবং শব্দের মাধ্যমে সেই বিভাজনকে মিলিত রূপ দেওয়া যায়।

মরিসনের কবিতা শুধু শব্দ নয়। এটি মানসিক ভ্রমণ, জীবনের চলচ্চিত্র। প্রতিটি ছবি পাঠককে অন্তরের অচেনা জায়গায় নিয়ে যায়। তার লেখা চিরকাল আমাদের সঙ্গে থাকে; ছায়া ও আলোর সঙ্গে মিলিত হয়।

জিম মরিসন ছিলেন পুরোদস্তুর কবি, ভবঘুরে, বিদ্রোহী। তিনটি পরিচয় একসঙ্গে মিশে গিয়ে তৈরি করেছে তার 'পারসোনা'। তার কবিতা ও গান চিরায়ত এবং আইকনিক। আমরা যখন তার লেখা পড়ি, তখন শুধু শব্দই পড়ি না; আমরা দেখি একটি জীবনের খণ্ডচিত্র, একটি মানুষের অন্তর্গত যুদ্ধ।

Comments

The Daily Star  | English

Which countries are affected by Trump's latest travel bans to the US?

US President Donald Trump signed a proclamation on Tuesday further restricting the entry of foreign nationals to the United States.

17m ago