হারিয়ে যাবে শীত, ডুবে যাবে দেশের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ
শতাব্দীর শেষ নাগাদ হয়ত পৌষের কুয়াশা আর থাকবে না। মাঘ মাসেও দিব্বি হাফ শার্ট পরেই ঘুরে বেড়ানো যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তখন শীত আর থাকবেই না।
গড় তাপমাত্রা সাড়ে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। আর সেই সঙ্গে সমুদ্রের পানি বাড়তে বাড়তে ডুবিয়ে দেবে উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা। বিলীন হয়ে যেতে পারে দেশের প্রায় ১৮ শতাংশ।
২০৫০ সালের মধ্যে বন্যায় ঘরবাড়ি হারাতে পারেন প্রায় ৯ লাখ মানুষ।
'বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জলবায়ু' শীর্ষক নতুন এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেশের জলবায়ু সংকট নিয়ে গভীর এসব উদ্বেগ জানানো হয়েছে। গতকাল বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও নরওয়েজিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট যৌথভাবে এই প্রতিবেদন প্রণয়ন করেছে। যেখানে কারিগরি সহায়তা প্রদান করেছে সেভ দ্য চিলড্রেন।
এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ। সহ-লেখক ছিলেন কাইসা পার্ডিং, হ্যান্স ওলাভ হাইজেন, আফরোজা সুলতানা, ইয়ান ইভেন ওয়ে নিলসেন ও এস এম কামরুল হাসান।
এ বিষয়ে বজলুর রশিদ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে ২০১১ সাল থেকে কাজ করছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও নরওয়েজিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট। এটি তাদের তৃতীয় প্রতিবেদন, যেখানে পাঁচ ধরনের জলবায়ু পরিস্থিতির বিষয়ে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে শতাব্দীর বাকি সময়কে দুটি ভাগে (২০৪১-২০৭০ সাল) ও (২০৭১-২১০০ সাল) ভাগ করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে কী-নোট উপস্থাপন করেন নরওয়ের আবহাওয়াবিদ হ্যান্স ওলাভ হাইজেন। পরে প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরেন বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ।
এ বিষয়ে হ্যান্স ওলাভ হাইজেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জলবায়ু সম্পর্কে পূর্বাভাস প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে আমরা কিছু অন্ধকার দিক দেখতে পেলেও প্রতিবেদনের ভালো দিকটি হলো, বাংলাদেশের জন্য সমস্যা সৃষ্টির আগেই পদক্ষেপ নিতে এবং জলবায়ু অভিযোজন নিয়ে লেখালেখির দ্বার উন্মোচন করেছে।'
বজলুর রশিদ বলেন, 'এটি প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জলবায়ু নিয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রজেকশন রিপোর্ট। এটা ভালো লক্ষণ যে, প্রতিবেদনটিতে শুধু প্রক্ষেপণই নয়, সারমর্মও তুলে ধরা হয়েছে, যে তীব্র তাপপ্রবাহ, কম শীত বা চরম আবহাওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যখাতসহ বিভিন্ন খাতে আমাদের কী করা প্রয়োজন, বিশেষ করে বিভিন্ন সেক্টরের নীতিনির্ধারক বা পরিকল্পনাবিদদের কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ।'
তাপমাত্রা বৃদ্ধি
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে দেশের তাপপ্রবাহ আরও বেড়ে যাবে এবং দেশের পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় সারা বছরই তীব্র গরম থাকতে পারে।
যদি গ্রিনহাউস গ্যাস কমানো না যায়, তাহলে ২০৪১-২০৭০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। ২১০০ সালের মধ্যে যা বেড়ে ১ দশমিক ৫ থেকে ৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উন্নীত হতে পারে।
ঘন ঘন তাপপ্রবাহ
এতে জানানো হয়, বর্ষার আগের (মার্চ-মে) সময়টিতে তাপপ্রবাহ আরও ঘন ঘন দেখা দিতে পারে। ২০৭০ সালের মধ্যে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে বর্ষার আগে ২০ দিন পর্যন্ত তাপপ্রবাহ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, যা বর্তমান সময়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বেশি। বর্ষা মৌসুমেও তাপপ্রবাহ বাড়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২১০০ সালের মধ্যে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে বর্ষা মৌসুম শুরুর আগের ৯০ দিনের মধ্যে ৭০ দিনই তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
রাজধানী ঢাকার পরিস্থিতি আরও কঠিন হতে পারে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বছরে অন্তত দুটি প্রবল তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হতে পারেন নগরবাসীরা। একটি বর্ষার আগে, আরেকটি বর্ষার পরে।
বিলুপ্ত হতে পারে শীত
পূর্বাভাস অনুযায়ী, তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চল থেকে শীতের আবহও সরে যাবে। শতাব্দীর শেষদিকে শীত মৌসুম প্রায় নাই হয়ে যেতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু এলাকায় ডিসেম্বর–জানুয়ারিতে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ মাত্র এক-দুদিন অনুভূত হতে পারে।
এতে আরও বলা হয়, বেশিরভাগ সময় দেশের উত্তর, পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় শৈত্যপ্রবাহ দেখা দিতে পারে।
বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন
ভবিষ্যতে বর্ষায় অতিরিক্ত বৃষ্টির সম্ভাবনা অনেক বেশি। নতুন পূর্বাভাস বলছে, ২০৭০ সালের মধ্যে বর্ষায় মোট বৃষ্টিপাত গড়ে ১১৮ মিলিমিটার বেড়ে যেতে পারে, আর শতাব্দীর শেষে এই হার গড়ে প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়ে ২৫৫ মিলিমিটারে উন্নীত হতে পারে।
প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টি বাড়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এই অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা ও ভূমিধস বাড়বে বলে সতর্ক করা হয়েছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি
প্রতিবেদনে জানানো হয়, পৃথিবী গরম হওয়ায় সমুদ্রের পানি ফুলে ওঠে এবং বরফ গলে পানি বাড়ে। এর ফলে বাংলাদেশে উপকূলীয় এলাকায় বন্যা বাড়বে।
এতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর ৩ দশমিক ৮ থেকে ৫ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃদ্ধি পাবে, যেখানে বৈশ্বিক গড় ২ দশমিক ১ মিলিমিটার।
এই বৃদ্ধির ফলে স্থায়ী উপকূলীয় প্লাবনের সম্ভাবনা রয়েছে, যার ফলে শতাব্দীর শেষ নাগাদ বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১২ থেকে ১৮ শতাংশ ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের এই তীব্র বৃদ্ধির ফলে ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের ৯১৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা (২৩ শতাংশ) প্লাবিত হতে পারে।
এ কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ৯ লাখ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারাতে পারেন বলেও পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবিকায় প্রভাব
প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশি গরমে ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে। তীব্র গরমে শ্রমিকদের কাজ করা কঠিন হবে এবং তাদের স্বাস্থ্য-ঝুঁকি বাড়বে। এমনকি সমুদ্রের পানি বাড়লে লবণাক্ততা বাড়বে, ফলে ফসল, মাছ ধরা ও পানির উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কেন ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি
গবেষকরা জানান, জলবায়ু পরিবর্তন একদিনে থামানো যাবে না, এমনকি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমালেও কিছু পরিবর্তন হবে। কিন্তু গ্যাস ও দূষণ কমানো না গেলে ভবিষ্যতের ক্ষতি হবে ভয়াবহ।
এজন্য তারা দুইভাবে কাজের সুপারিশ করেছেন, যেমন: প্রশমন বা দূষণ কমানো এবং অভিযোজন বা ক্ষতি ক্ষমাতে প্রস্তুতি নেওয়া (বাঁধ, আশ্রয়কেন্দ্র ও প্রযুক্তির ব্যবহার)।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মমিনুল ইসলাম বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের গতি দ্রুততর হচ্ছে এবং আমাদের গ্রহের উষ্ণায়ন এখন স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সাল রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ উষ্ণ বছরগুলোর একটি এবং অক্টোবর ২০২৫ ইতোমধ্যে বৈশ্বিক ইতিহাসের সর্বাধিক উষ্ণ অক্টোবরগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।'
'বর্তমান হারে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশে মধ্য-শতাব্দীতে ১–২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং শতাব্দীর শেষে ১ দশমিক ৫–৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে। বৃষ্টিপাতের ধরনে বড় পরিবর্তন আসবে এবং বর্ষায় বৃষ্টিপাত ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে—বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে', বলেন তিনি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আরও বলেন, 'বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যানের (এনএপি) মাধ্যমে জলবায়ু সহনশীল কৃষি, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, টেকসই নগরায়ন এবং প্রকৃতি-নির্ভর সমাধানসহ গুরুত্বপূর্ণ অভিযোজন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এসব উদ্যোগ প্রমাণ করে যে, ভবিষ্যতের ঝুঁকি মোকাবিলায় বৈজ্ঞানিক জলবায়ু প্রক্ষেপণ কতটা গুরুত্বপূর্ণ।'
অনুষ্ঠানে নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হ্যাকন অ্যারাল্ড গুলব্র্যান্ডসেন বলেন, 'এই রিপোর্টে বাংলাদেশের জলবায়ু প্রক্ষেপণ খুবই স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ২১০০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়তে পারে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা উপকূলীয় মানুষকে হুমকিতে ফেলবে, আর তীব্র হিটওয়েভ স্বাস্থ্য, কৃষি ও নিরাপদ পানির ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করবে। এগুলো আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা।'
বাংলাদেশ, বিএমডি এবং জাতীয় অংশীদারদের জলবায়ু সহনশীলতা জোরদারে সহযোগিতা করা নরওয়ে সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে বলেও জানান তিনি।
বলেন, 'বাংলাদেশ একটি দৃঢ় ও সহনশীল দেশ এবং এই প্রতিবেদন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, জলবায়ু পদক্ষেপে ধারাবাহিক প্রতিশ্রুতি অপরিহার্য। সামনে নির্বাচন এবং আমি আশা করি রাজনৈতিক দলগুলো এসব প্রক্ষেপণ তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেবে।'
এ সম্পর্কে সেভ দ্য চিলড্রেন জানায়, প্রতিবেদনটি জাতীয় পরিকল্পনা, অভিযোজন কৌশল এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রমে ব্যবহারযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রদান করে।
তারা আরও জানায়, ভবিষ্যৎ জলবায়ু প্রক্ষেপণকে অ্যান্টিসিপেটরি অ্যাকশন, কমিউনিটি প্রস্তুতি এবং শিশু-কেন্দ্রিক জলবায়ু সহনশীলতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা অত্যন্ত জরুরি। বৈজ্ঞানিক তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণই ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে ক্রমবর্ধমান জলবায়ু বিপর্যয় থেকে সুরক্ষিত রাখতে সহায়তা করবে।


Comments