‘পানি আমাদের জীবনের সংগ্রাম’

পানি সংকট
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় পানির সংকট। ছবি: আনোয়ার আলী/স্টার

আমন ধান চাষের জন্য ২৩ বিঘা জমি প্রস্তুত করেছিলেন নওগাঁর পোরশা উপজেলার কামারধা গ্রামের কৃষক বিদ্যুৎ কুমার মন্ডল। পানির অভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তার চাষাবাদ কার্যক্রম।

গত ৩ সপ্তাহে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ বৃষ্টি না হওয়ায় রোদে পুড়ছে জমি, শুকিয়ে যাচ্ছে আমনের বীজতলা।

বর্ষা মৌসুম শেষ হতে আর মাত্র ২ সপ্তাহ বাকি। আষাঢ়ে যেটুকু বৃষ্টি হয়েছে তাতে বিদ্যুৎ এ পর্যন্ত মাত্র সাড়ে ৪ বিঘা জমিতে ধান রোপণ করতে পেরেছেন। পুরো শ্রাবণে যেটুকু বৃষ্টি হয়েছে তাতে তার জমির বেশির ভাগই শুকনো থেকে গেছে।

'শ্রাবণের বাকি ২ সপ্তাহে বৃষ্টি না হলে আমার সব শেষ হয়ে যাবে,' বলেন বিদ্যুৎ। তাঁর কণ্ঠে অনিশ্চয়তার চিহ্ন স্পষ্ট।

পোরশা উপজেলার কৃষক তার আশেপাশের বেশিরভাগ এলাকার মতো জীবিকা নির্বাহে বৃষ্টিপাতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ভূপৃষ্ঠ এবং ভূগর্ভস্থ পানি সেখানে দুর্লভ সম্পদ।

বিদ্যুৎ বলেন, 'বৃষ্টির পানি না থাকলে, আমরা সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করি। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানি আবার সব জমিতে নেওয়া যায় না।'

'যেসব এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি আছে সেখানেও পানির পরিমাণ কমছে। প্রতি বছর দেখি আগের বছরের তুলনায় পরের বছর সেচ দেওয়ার সময় বৃদ্ধি পায় এবং পানির প্রবাহ কমে যায়,' বলেন তিনি।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) সহকারী প্রকৌশলী মো. কাজিমউদ্দিন জানান, উপজেলায় ২২ হাজার ২৮৬ হেক্টর আবাদি জমি রয়েছে। ২৮৩টি গভীর নলকূপ দিয়ে মাত্র ৯ হাজার ২৫২ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া যায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) কর্মকর্তারাও এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

পানি সংকট
চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে খাবার পানির খোঁজে এক নারী। ছবি: আনোয়ার আলী/স্টার

বিদ্যুৎ-এর দুর্দশা এই অঞ্চলের কৃষকদের বৃহত্তর একটি সংগ্রামের প্রতিফলন। তাদের দুশ্চিন্তা, ফসল বাঁচানোর জন্য কি সময় মতো বৃষ্টি হবে?

ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) ২০১৩ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের জন্য উপজেলাটি মোটেই উপযুক্ত নয়।

পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো) ও আইডব্লিউএম'র সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, উপজেলার ছাওড়, তেঁতুলিয়া ও গাংগুরিয়া ইউনিয়নে উপযুক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনযোগ্য কোনো অ্যাকুফার নেই।

ছাওড় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নুরুল হুদা বলেন, 'এই ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন অনেক ব্যয়বহুল। পানি পেতে আমাদের ৪০০ ফুটেরও বেশি খনন করতে হয়। নিম্নাঞ্চলের কৃষকদের যেখানে খরচ হয় ১১০ টাকা, প্রতি ঘণ্টায় আমাদের সেচ খরচ হয় ১৫০ টাকা।'

ছাওড় ইউনিয়নের বলদাহার গ্রামের কৃষক মতিউর রহমান জানান, ভূগর্ভস্থ পানি তোলার জন্য একটি সাবমার্সিবল পাম্প বসাতে তার খরচ হয়েছে ১০ লাখ টাকা, যে কোনো নিম্নাঞ্চলে এই খরচ ৩ লাখের বেশি হতো না।

'তাছাড়া, এই পাম্পগুলো দিয়ে আমাদের ৪০ বিঘা জমিতে চাষাবাদ করা কঠিন,' তিনি যোগ করেন।

আমন চাষের জন্য রহমান তার ১৬ বিঘা জমিতে ৩ হাজার ফুট (১ কিলোমিটারের ২৮০ দশমিক ৮৪ ফুট কম) দূরে এমন একটি পাম্প থেকে পানি পাইপ দিয়ে নিয়ে আসেন।

একই গ্রামের আরেক কৃষক সতীশ ওরাও বলেন, 'পানির জন্য আমাদের সংগ্রাম কখনো শেষ হওয়ার নয়...এটা আমাদের জীবনের সংগ্রাম।'

তিনি বলেন, 'গত বছর বৃষ্টির কারণে অন্তত পুকুর ও খালে পানি ছিল কিন্তু এ বছর জলাশয়গুলো এখনো ভরাট (টইটম্বুর) হয়নি। আমার গ্রামের প্রায় ৩৫টি পরিবারের জন্য একটি সাবমার্সিবল পাম্প আছে। সেটাতেও পানি কমে যাচ্ছে।'

ইউপি চেয়ারম্যান সাদেকুল ইসলাম বলেন, 'সরকার খাবার পানির জন্য গ্রামে ৩ হাজারেরও বেশি সাবমার্সিবল পানির পাম্প স্থাপন করেছে কিন্তু সেচের পানির সংকট রয়েই গেছে।'

স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার সরকার জানান, 'পোরশা ও সাপাহার উপজেলার কৃষকরা পানির অভাবে তাদের অধিকাংশ ধানের জমি আম বাগানে পরিণত করেছেন।'

'আম চাষ মূলত বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভরশীল। কিছু কৃষক আম বাগানে সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে তাদের বাগানের কাছে পুকুর খনন করেছেন,' বলেন সঞ্জয়।

Comments

The Daily Star  | English
govt employees punishment rule

Govt employees can now be punished for infractions within 14 working days

Law ministry issues ordinance amending the Public Service Act, 2018

2h ago