কুয়াকাটায় ৮ বছরে ভেসে এসেছে ১৩৫ ডলফিন, মৃত্যুর কারণ অজানা

গত আট বছরে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে অন্তত ১৩৫টি মৃত ডলফিন ভেসে এসেছে। কিন্তু মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে একটিরও ময়নাতদন্ত করা হয়নি। ফলে বঙ্গোপসাগরের এই স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলোর মৃত্যুর মিছিলের পেছনের রহস্য অজানাই থেকে যাচ্ছে।
স্থানীয় জেলেদের ভাষ্য, মাছ ধরার জালে আটকা পড়ে, পানির দূষণ বা জাহাজের ধাক্কায় ডলফিন মারা যাচ্ছে। তবে সরকারি রেকর্ডে অনেক ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ হিসেবে 'স্বাভাবিক মৃত্যু' উল্লেখ করা হয়।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও মৎস্য গবেষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, 'সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র কতটুকু ভালো আছে তা বোঝা যায় ডলফিনদের দেখে। বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে এদের উপস্থিতি জরুরি। সুনীল অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখতে হলে ডলফিনকে নিরাপদ অভয়ারণ্য দিতে হবে।'
সর্বশেষ গত ২০ সেপ্টেম্বর কুয়াকাটা সৈকতের গঙ্গামতি পয়েন্টে ১০ ফুট লম্বা একটি ইরাবতী ডলফিনের মৃতদেহ ভেসে আসে। এটির শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন ছিল এবং বিভিন্ন স্থানের চামড়া উঠে গিয়েছিল। এর আগে ৪ সেপ্টেম্বর একই প্রজাতির আরেকটি ডলফিনের মরদেহ পাওয়া যায়। এ ছাড়া ১ আগস্ট একটি বটলনোজ এবং ১৩, ১৪ ও ৩১ আগস্ট তিনটি ইরাবতী ডলফিনের মরদেহ ভেসে আসে।
মৃত ডলফিনগুলোর দুর্গন্ধে পর্যটকদের ভোগান্তি হওয়ায় 'কুয়াকাটা উপকূল পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন (উপরা)' নামে একটি সংগঠন বন বিভাগ ও কুয়াকাটা পৌরসভার সহযোগিতায় সেগুলোকে সৈকতেই মাটিচাপা দেওয়ার কাজ করছে।
উপরা-এর সদস্য কে এম বাচ্চু ২০১৭ সাল থেকে ভেসে আসা ডলফিনের মরদেহ মাটিচাপা দেওয়ার কাজের সঙ্গে যুক্ত। তিনি বলেন, 'দুর্গন্ধ ছড়ানোয় প্রথমে নিজেই মাটিচাপা দেওয়া শুরু করি। পরে আমরা সংগঠন গড়ে এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।' তিনি আরও বলেন, 'বেশিরভাগ ডলফিনের শরীরেই আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়। জাহাজের প্রপেলারের আঘাতে বা জেলের জালে আটকা পড়ে এগুলো মারা যেতে পারে। ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৩৫টি মৃত ডলফিন ভেসে এসেছে, কিন্তু একটিরও ময়নাতদন্ত হয়নি।'
ওয়ার্ল্ডফিশের সহযোগী গবেষক বখতিয়ার উদ্দিন অভিযোগ করেন, কিছু অসাধু জেলে নদীর মোহনায় বিষ দিয়ে মাছ ধরে, যা ডলফিনের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
কুয়াকাটা ডলফিন রক্ষা কমিটির দলনেতা রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, 'চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ১২টি মৃত ডলফিন ভেসে এসেছে। ২০২৪ সালে ১০টি এবং ২০২৩ সালে এরকম ১৫টি ঘটনার কথা জানা যায়। আমরা কর্তৃপক্ষকে মৃত্যুর সঠিক কারণ অনুসন্ধানের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।'
বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির সহযোগী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি বলেন, 'উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের দেশে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষার প্রচেষ্টা অপর্যাপ্ত। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ প্রয়োগ না করা হলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।'
বন বিভাগের মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা এ কে এম মনিরুজ্জামান বলেন, 'ডলফিন রক্ষা কমিটির কাছ থেকে খবর পেলেই আমাদের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়ানোর আগেই মরদেহ মাটিচাপা দেয়। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাবে আমরা ময়নাতদন্ত করতে পারি না।'
তিনি আরও বলেন, 'এখানে কোনো ল্যাব না থাকায় ময়নাতদন্ত সম্ভব নয়। ফরেনসিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য আমরা একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত ল্যাব স্থাপনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।'
Comments