বান্দরবানে বর্জ্যে দূষিত সাঙ্গু নদী, সংকটে প্রাণ-প্রকৃতি  

ছবি: মংসিং হাই মারমা/স্টার

চার দশক পেরিয়ে গেলেও বান্দরবান শহরে কোনো স্থায়ী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র বা ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণ করা হয়নি। ফলে শহরের হাসপাতাল, হোটেল, বাজার ও গৃহস্থালীর বর্জ্য খোলা আকাশের নিচে পাহাড়ে ফেলা হচ্ছে। এসব বর্জ্য সোজা সাঙ্গু নদীতে গিয়ে পড়ছে। এই দূষিত নদীর পানির ওপর নির্ভর করেই টিকে আছে এর তীরবর্তী আদিবাসীসহ হাজারো মানুষের জীবন-জীবিকা। শুধু তাই নয়, আশেপাশের জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়ছে।

চারদিকে পাহাড়ঘেরা সাঙ্গু নদীর তীরে বিস্তৃত বান্দরবান শহর। ১৯৮৪ সালে গঠিত এই শহর ২০০১ সালে 'ক' শ্রেণির পৌরসভায় উন্নীত হয়। বর্তমানে প্রায় এক লক্ষাধিক মানুষের আবাস বান্দরবান।

কিন্তু চার দশক পেরিয়ে গেলেও শহরটিতে আধুনিক ও উন্নতমানের স্থায়ী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র নেই। ফলে শহরের অন্তত ৩০–৪০ টন বর্জ্য পৌরসভার বর্জ্য বহনকারী ছোট-বড় ট্রাকে করে প্রতিদিন নিকটবর্তী পাহাড়ে ফেলা হচ্ছে। এসব বর্জ্য পাহাড়ি ঢলে সাঙ্গু নদীতে চলে যাচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, বান্দরবান শহর থেকে মাত্র দেড়শ মিটার দূরত্বে সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ার উপরেই পৌরসভার এই বর্জ্যস্তূপ। জেলা শহর ও বর্জ্যের পাহাড়ের মাঝখানে বয়ে গেছে সাঙ্গু নদী। আর বর্জ্যপাহাড়টি বান্দরবান-রোয়াংছড়ি উপজেলার প্রধান সংযোগ সড়ক। এই সড়ক দিয়েই শিক্ষার্থীসহ হাজারো মানুষ যাতায়াত করছে। 

সড়কের দুই পাশে ছড়িয়ে আছে হাসপাতালের ওষুধের কাঁচের বোতল, সুই-সিরিঞ্জ, অপারেশন থিয়েটারে ব্যবহৃত জিসিনপত্র, সাথে পচা সবজি, মাছ-মাংসের বর্জ্য, প্লাস্টিক ও পলিথিনের স্তূপ।

এসব বর্জ্যের একাংশ পৌর ড্রেন বেয়ে চলে যায় সাঙ্গু নদীতে। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির সাথে পাহাড়ি ঢলে বা পাহাড়ে নিচে ঝিরি-ছড়া দিয়ে বর্জ্যগুলো ভেসে নদীতে গিয়ে পড়ে। 

বান্দরবানের সাঙ্গু নদী-তীরবর্তী লাংগি পাড়া, ক্যমলং পাড়া, কোহালং পাড়া, ভাঙ্গামোড়া মারমা পাড়া, বড়ুয়া পাড়া ও গোয়ালিয়াখোলা মুসলিম পাড়ায় অন্তত ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ নদীটির পানির ওপর নির্ভরশীল।

সাঙ্গু নদী থেকে প্রতিদিন কলস ভরে পানি নেন ভাঙ্গামোড়া পাড়ার মেয়ইংনু মারমা। তিনি বলেন, 'আমরা চৌদ্দপুরুষ ধরে এই নদীর পানি খেয়ে বেঁচে আছি। এখন নদীর পানি কালো হয়ে গেছে, দুর্গন্ধ আসে। তবু এই পানিই আনতে হয়, অন্য কোনো ব্যবস্থা তো নেই। নদী না থাকলে আমরা বাঁচতাম না। এখন নদী আছে, তবু বাঁচাটা কঠিন হয়ে গেছে।'

ক্যমলং পাড়ার বাসিন্দা চাথোয়াই অং মারমা বলেন, 'আগে নদীর পানি ঠান্ডা, স্বচ্ছ আর পানের উপযোগী ছিল। এখন পানিতে পচা গন্ধ পাই, প্লাস্টিক ভেসে আসে। তবুও আমরা বাধ্য হয়ে এই পানি ব্যবহার করি।'

জেলা শহরে জিরো পয়েন্টে সাঙ্গু ব্রিজের আশপাশের এলাকার একাধিক হোটেলগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, নদীর পাড় থেকে পাইপ বসিয়ে সরাসরি পানি তোলা হচ্ছে।

আবাসিক হোটেল সুমাইয়ার ম্যানেজার মো. ওয়াহিদ বলেন, 'আমরা শহরে ওয়াসার সাপ্লাইয়ের পানি ব্যবহার করি। সাপ্লাইয়ের পানি না পেলে সরাসরি মোটর বসিয়ে সাঙ্গু নদীর পানি নেই।'

একই ঘটনা ঘটছে  সাঙ্গু ব্রিজের পাশের বাকি হোটেলগুলোতেও। এতে বান্দরবানের পর্যটন খাতও পরোক্ষভাবে দূষিত পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে।

 

জেলার পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে বান্দরবানে কোনো কার্যকর নীতি বা অবকাঠামো নেই। শহরের ড্রেন ও নালার মুখ নদীতে গিয়ে মিশেছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই নদীর পানি ফুলে-ফেঁপে শহরের ভেতর ঢুকে জলাবদ্ধতা ও হঠাৎ বন্যার সৃষ্টি করে।

পরিবেশকর্মী লেলুং খুমী বলেন, 'সাঙ্গু নদী ধীরে ধীরে মরতে বসেছে। তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে বর্জ্যে। এতে শুধু নদীর প্রাণ নয়, আশেপাশের জীববৈচিত্র্যও বিলীন হচ্ছে। অল্প বৃষ্টিতেই এখন বন্যা আর ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ছে।'

তিনি আরও বলেন, 'সাঙ্গু নদী শুধু একটি নদী নয়, পুরো বান্দরবানের জীবনরেখা। এখনই পদক্ষেপ না নিলে এটি মৃত নদীতে পরিণত হবে।'

দূষিত নদীর পানি ব্যবহারে ফলে স্থানীয়দের মধ্যে ডায়রিয়া, ত্বকের সমস্যা, আমাশয়, গ্যাস্ট্রিকসহ নানা রোগ বাড়ছে বলে জানান জেলার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক দ্বিলীপ চৌধুরী। তিনি বলেন, 'এই পানি দিয়ে রান্না বা গোসল করায় ব্যাকটেরিয়া শরীরে ঢুকছে। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে।'

বান্দরবান পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. রেজাউল করিম বলেন, 'নদীতে বর্জ্য ফেলা বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (ধারা ৬ ও ৭) এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১–এর পরিপন্থী। স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।'

জেলা পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এডিসি-সাধারণ) এসএম মঞ্জুরুল হক বলেন, 'জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ আধুনিক ও উন্নতমানের স্থানীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্টেশন নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে শুনেছি। প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়ে গেলে আমরা আর পাহাড়ে বর্জ্য ফেলব না।' 

জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পার্বত্য চট্টগ্রামে সমন্বিত ও টেকসই পৌর পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রকল্পের অধীনে বান্দরবান ও লামা পৌরসভায় বিশুদ্ধ পানি ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, স্থায়ী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্থাপনা নির্মাণের জন্য ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৫০ কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ করেনি জেলা প্রশাসন অফিস। অধিগৃহীত ভূমি আমাদের কাছে হস্তান্তর করলেই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারব।'

Comments