এক্সপ্লেইনার

যুক্তরাষ্ট্রে ‘শাটডাউন’ কী, কেন?

শাটডাউনের কারণে বন্ধ আছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট স্কাল্পচার গার্ডেন। ঢুকতে না পেরে এক দর্শনার্থী বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। ছবি: রয়টার্স
শাটডাউনের কারণে বন্ধ আছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট স্কাল্পচার গার্ডেন। ঢুকতে না পেরে এক দর্শনার্থী বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। ছবি: রয়টার্স

গত সেপ্টেম্বরজুড়ে পশ্চিমের দেশগুলোর গণমাধ্যমে একটি খবর বারবার ঘুরে ঘুরে শিরোনাম হচ্ছিল। 'শাটডাউন' হতে যাচ্ছে মার্কিন সরকার। গত ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে 'স্পেন্ডিং বিল' কংগ্রেসের অনুমোদন না পেলে 'শাটডাউন' হবে সরকার।

তবে ১ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া শাটডাউন কম্পিউটারের শাটডাউনের মতো বিষয় নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি সাময়িক পরিস্থিতি। এবং এটাই প্রথম শাটডাউন নয়।

আজকের এক্সপ্লেইনারে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানব।

মার্কিন ফেডারেল (কেন্দ্রীয়) সরকারের অর্থবছরের সংজ্ঞা

শাটডাউনের বিষয়ে বিস্তারিত জানার আগে মার্কিন ফেডারেল সরকারের অর্থবছর নিয়ে কিছুটা ধারণা প্রয়োজন।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই অর্থবছর শুরু হয় ১ জুলাই থেকে তা চলে পরের বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত।

শাটডাউনের মধ্যে মার্কিন ক্যাপটল ভবন। ছবি: রয়টার্স
শাটডাউনের মধ্যে মার্কিন ক্যাপটল ভবন। ছবি: রয়টার্স

বাংলাদেশে এখন ২০২৫-২৬ অর্থবছর চলছে, যা শুরু হয়েছে গত ১ জুলাই। শেষ হবে আগামী বছরের (২০২৬) ৩০ জুন। এই অর্থবছরের সঙ্গে অনেক সরকারি কার্যক্রম ও লক্ষ্যমাত্রার সরাসরি সংযোগ আছে। যেমন—বাজেট প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, রাজস্ব ও কর আদায়।

তবে মার্কিন ফেডারেল সরকারের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু ভিন্ন। ফেডারেল সরকারের অর্থবছর প্রতি ১ অক্টোবর শুরু হয়ে তা চলে পরের বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।

কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট বা অর্থায়ন (ফান্ডিং) এই সময়কাল মাথায় রেখেই নির্ধারণ করা হয়। তবে অঙ্গরাজ্যগুলোর নিজস্ব অর্থবছর ও বাজেট প্রক্রিয়া আছে। তাদের অর্থবছরের সংজ্ঞাও ভিন্ন।

মজার বিষয় হল, ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে মাত্র দুইটি কেন্দ্রীয় সরকারের সংজ্ঞা অনুসরণ করে। অন্য ৪৬টি অঙ্গরাজ্য গোটা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জুন-জুলাই সময়সীমা ব্যবহার করে।

বাকি দুই অঙ্গরাজ্যের মধ্যে নিউইয়র্কে ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ ও টেক্সাসে ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৩১ আগস্ট সময়কালকে অর্থবছর হিসেবে ধরা হয়।

কেন্দ্রীয় সরকারের এই অভিনব অর্থবছর নির্ধারণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পেছনে আছে ঐতিহাসিক ও যৌক্তিক কারণ। তবে ওই বিষয়গুলো এই লেখার বিষয় নয়।

কখন ও কেন শাটডাউন হয়

অন্য যেকোনো দেশের মতো মার্কিন ফেডারেল সরকারও তাদের অর্থবছরের শুরুর আগে ব্যয় এবং বরাদ্দের খসড়া বাজেট তৈরি করে। এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের বিলের প্রচল আছে।

বাজেটের প্রাথমিক উৎস হলো বার্ষিক বরাদ্দ। ১২টি গুরুত্বপূর্ণ খাতের (যেমন কৃষি, প্রতিরক্ষা, জ্বালানি ও শ্রম) জন্য ফেডারেল সরকার ১২টি বিল তৈরি করে।

আদর্শ পরিস্থিতিতে ৩০ সেপ্টেম্বরের আগেই ১২টি বিল পার্লামেন্টের অনুমোদন নিয়ে আইনে পরিণত হওয়ার কথা। তবে খুব কম ক্ষেত্রেই এটা হয়ে থাকে। সর্বশেষ ১৯৯৭ সালে অর্থবছর শুরু আগেই সবগুলো বিল আইনে পরিণত হয়েছিল।

মার্কিন হাউস স্পিকার মাইক জনসন। ফাইল ছবি: রয়টার্স
মার্কিন হাউস স্পিকার মাইক জনসন। ফাইল ছবি: রয়টার্স

বর্তমানে অননুমোদিত বিলগুলোকে একত্রিত করে পরবর্তীতে প্যাকেজ আকারে অনুমোদন দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া শেষ হতে ডিসেম্বর বা আরও বেশি সময় লেগে যায়।

কেন্দ্রীয় সরকারের এই বাজেট দেশটির পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটে বিল আকারে উত্থাপন করা হয়। এরপর তা নিয়ে চলে আলোচনা, বিশ্লেষণ ও ব্যবচ্ছেদ। সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনেটরদের অনুমোদন পেলে ওই বাজেটটি 'আইন' হিসেবে পাস হয়। সে অনুযায়ী ফেডারেল সরকারের পুরো অর্থবছরের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

অপর গুরুত্বপূর্ণ বিল হলো সাময়িক ধারাবাহিকতা রক্ষার সমাধান (সিআর)। সিআরকে স্বল্পমেয়াদি ও এককালীন বিল হিসেবে দেখা হয়। এর মাধ্যমে নতুন বরাদ্দ প্যাকেজ অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত আগের অর্থবছরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অর্থায়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হয়। এর মাধ্যমে কোনো ধরনের বিঘ্ন ছাড়াই জরুরি সেবা ও দৈনন্দিন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে সরকার। তবে সিআর বলবত থাকা অবস্থায় নতুন করে কোনো উদ্যোগ চালু, চলমান কার্যক্রমের সংস্কার বা বাতিল করা হয় না।

সিআরের মাধ্যমে দীর্ঘসময় ধরে সরকার কাজ করে যেতে পারে।

তবে এবারের শাটডাউনে সিআর ব্যবহার হয়নি। ফলে সরকারি কার্যক্রমে বাধা এসেছে।

নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে কোনো কারণে বাজেটের বিষয়ে কংগ্রেসের সদস্যরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলেই শাটডাউন দেখা দেয়।

শাটডাউন হলে কী কী সমস্যা দেখা দেয়?

শাটডাউনের সময় মার্কিন সরকারের অনেক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। অসংখ্য কর্মীর বেতন বন্ধ হয়। অনেকে বেতন না পেয়েও কাজ করে যেতে বাধ্য হন।

মূলত ১ অক্টোবরের মধ্যে কংগ্রেসে বাজেট বিল পাস না হলে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থায়নে ঘাটতি দেখা দেয়। অর্থাৎ, সেক্ষেত্রে দৈনন্দিন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট অর্থ থাকে না সরকারের হাতে।

এ ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলায় 'জরুরি নয়' এমন সরকারি সেবা স্থগিত রাখা হয়। এ ধরনের সেবার সঙ্গে জড়িত কর্মীদের তাৎক্ষণিকভাবে অবৈতনিক ছুটিতে পাঠানো হয় বা সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

শাটডাউনের মধ্যে বন্ধ আছে স্মিথসোনিয়াম যাদুঘর। ছবি: রয়টার্স
শাটডাউনের মধ্যে বন্ধ আছে স্মিথসোনিয়াম যাদুঘর। ছবি: রয়টার্স

শাটডাউন হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও অন্যান্য জরুরি সেবা, পরিবহন ও উড্ডয়ন খাত, স্বাস্থ্য ও মানবিক সেবা, আর্থিক ও অর্থনৈতিক সেবা এবং অন্যান্য অত্যন্ত জরুরি সেবা (দূতাবাস, মহাকাশ সংস্থা, দমকল, আবহাওয়া বিভাগ, স্মৃতিস্তম্ভ ও পার্ক সেবা) চালু থাকে।

তবে অনেক সময় এসব সেবার সঙ্গে জড়িতরা বাজেট অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত বিনা বেতনে কাজ করে যেতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে বাজেট পাস পেলে তারা বকেয়া অর্থ পান।

কেন্দ্রীয় সরকারের মোট কর্মীবহরের ৬০ শতাংশই এসব সেবার সঙ্গে জড়িত।

যে কারণে চলতি বছরের শাটডাউন

আজ ১৪ অক্টোবর এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে শাটডাউন অব্যাহত ছিল।

রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মতের ভিন্নতা থেকেই শাটডাউন পরিস্থিতি অব্যাহত রয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটের প্রাধান্যের বিষয়গুলোয় দুই দল একমত হতে পারেনি।

গত জুলাইয়ে ট্রাম্পের 'বিগ বিউটিফুল বিলে' চিকিৎসা সহায়তা খাতে বাজেট কমানোর প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন ডেমোক্র্যাট সিনেটররা।

শাটডাউনের মধ্যে বন্ধ আছে অনেক সরকারি যাদুঘর। ছবি: রয়টার্স
শাটডাউনের মধ্যে বন্ধ আছে অনেক সরকারি যাদুঘর। ছবি: রয়টার্স

রিপাবলিকানরা এমন বিল চান, যেখানে শুধু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর উল্লেখ থাকবে। ডেমোক্র্যাটরা চাচ্ছেন জুলাইয়ে পাস হওয়া 'বিগ বিউটিফুল বিল' এ উল্লেখিত ৬৩৮ বিলিয়ন ডলারের চিকিৎসা সহায়তা (মেডিকএইড) বাজেট কর্তনের সিদ্ধান্ত বাতিল হোক।

উভয় পক্ষ তাদের অবস্থান থেকে সরে আসতে রাজি না হওয়ায় প্রায় দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও শাটডাউন পরিস্থিতির নিরসন হয়নি।

এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আট লাখ কর্মী। বন্ধ হয়েছে ন্যাশনাল পার্ক। বন্ধ আছে আইআরএসের কর রেয়াত প্রক্রিয়া।

হোয়াইট হাউসের অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টাদের কাউন্সিলের প্রতিবেদনে বলা হয়—এই শাটডাউনে প্রতি সপ্তাহে ১৫ বিলিয়ন ডলার জিডিপি লোকসান দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি, পুরো ত্রৈমাসিকে শূন্য দশমিক দুই শতাংশ জিডিপি কমার ঝুঁকি রয়েছে, যার মোট মূল্যমান ৩০ দশমিক চার ট্রিলিয়ন।

এক মাস এই অচলাবস্থা চললে ৪৩ হাজার মানুষ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।

গত সোমবার ১৩ অক্টোবর মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট চলমান শাটডাউন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি জানান, 'পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে পড়ছে। এখন তা অর্থনীতির ওপর (নেতিবাচক) প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।'

Comments

The Daily Star  | English

House rent allowance for MPO teachers raised to 15%, effective in two phases

7.5% house rent allowance from Nov 1, rising to 15% from July 1 next year

46m ago