এক্সপ্লেইনার

বিদেশিদের হাতে ‘বন্দর তুলে দেওয়া’ নিয়ে এত আশঙ্কা কেন?

অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কনটেইনার টার্মিনালগুলো পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে চলছে জোর আলোচনা। সরকারের এই সিদ্ধান্ত যেমন একদিকে দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়নের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি অন্যদিকে স্বচ্ছতার অভাব, জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি, অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন এবং দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা নিয়ে গভীর উদ্বেগও সৃষ্টি করেছে।

কোন টার্মিনাল কার হাতে তুলে দিচ্ছে সরকার?

গত ১৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালটি ৩০ বছরের জন্য পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে ডেনমার্কভিত্তিক শিপিং ও লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠান এপি মোলার মায়ের্স্ক (এপিএম)। এছাড়া, একইদিনে বুড়িগঙ্গার পাড়ে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালকে ২২ বছরের জন্য সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেডলগের দায়িত্বে দিতে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার।

নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল। এখানকার ৪৪ শতাংশ কন্টেইনার সামলায় এনসিটি। এই টার্মিনালে একসঙ্গে চারটি সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ ও একটি অভ্যন্তরীণ নৌপথের ছোট জাহাজ ভেড়ানো যায়। এনসিটিতে জাহাজ থেকে বার্ষিক ১০ লাখ একক কনটেইনার ওঠানো-নামানোর স্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে। গত বছর এই টার্মিনাল ১২ লাখ ৮১ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডেল করেছে।

দেশীয় প্রতিষ্ঠান দরপত্রের মাধ্যমে গত ১৭ বছর ধরে এনসিটি টার্মিনালটি পরিচালনা করছে। এখন এটি পরিচালনা করছে নৌবাহিনী নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান চিটাগং ড্রাইডক লিমিটেড। ২০২২-২৩ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) এনসিটি থেকে মোট রাজস্ব আয় করেছে ১ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। আর ব্যয় বাদে লাভ হয়েছে ৫৭৪ কোটি টাকা। এটিকেও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

তবে এনসিটি পরিচালনা করতে বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিদেশি কোম্পানির চুক্তি-সম্পর্কিত প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে শুনানি চলছে। নিষ্পত্তি হলে সরকার টার্মিনালটি সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডকে পরিচালনা করতে দিয়ে দেবে। তার আগ পর্যন্ত বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি-সম্পর্কিত প্রক্রিয়া চালানো যাবে না বলে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

এর আগে গত বছরের জুনে চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা টার্মিনাল পরিচালনার কার্যক্রম শুরু করে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই)। তবে এখনো প্রতিষ্ঠানটি কন্টেইনার পরিচালনায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহের পর্যায়ে আছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের বাকি দুটি টার্মিনাল দেশীয় বেসরকারি বার্থ অপরারেটর পরিচালনা করছে—চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) ও জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি)। এর মধ্যে সিসিটি মোট কনটেইনারের ১৯ শতাংশ এবং জিসিবি ৩৭ শতাংশ হ্যান্ডেল করে।

বন্দরে কন্টেইনার কম বা বেশি পরিবহন হয় মূলত বৈদেশিক বাণিজ্য কম-বেশির ওপর। চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর, যা দেশের আমদানি-রপ্তানির ৯০ শতাংশেরও বেশি হ্যান্ডেল করে।

বন্দরের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে এই বন্দরে ৩০ লাখ ৫০ হাজার ৭৯৩ একক কনটেইনার পরিবহন হয়েছে। ২০২৪ সালে তার তুলনায় সোয়া দুই লাখ বেড়ে এর পরিমাণ হয়েছে ৩২ লাখ ৭৫ হাজার একক কনটেইনার। এ হিসাবে কনটেইনার পরিবহন বেড়েছে ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

তবে বন্দরের সক্ষমতা আরও বাড়ানোর অংশ হিসেবে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলা হচ্ছে।

বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে 'গোপন চুক্তি' নিয়ে বিতর্ক কেন?

বন্দর ব্যবস্থাপনায় বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তির বিপক্ষে দেশের স্বার্থ রক্ষাসহ কৌশলগত, অর্থনৈতিক এবং প্রক্রিয়াগত নানা উদ্বেগ দেখিয়ে জোর সমালোচনা চলছে নানা পক্ষ থেকে। গত ১৭ নভেম্বর সম্পাদিত চুক্তিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমস কী পরিমাণ ট্যারিফ, মাশুল, চার্জ, শুল্ক-কর ইত্যাদি পাবে, সেই বিষয়গুলো গোপন রাখা হয়েছে।

এ নিয়ে সমালোচনার প্রেক্ষিতে সরকার বলছে, লালদিয়া এবং পানগাঁও বন্দর পরিচালনায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হওয়া চুক্তিটি নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (গোপন চুক্তি)। তাই এ নিয়ে খুব বেশি তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না।

নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট (এনডিএ) তখনই জরুরি হয়, যখন দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে গোপন তথ্য বিনিময় হয়। সেই তথ্য বাইরে ফাঁস হলে ব্যবসায়িক, আর্থিক, আইনি বা ব্যক্তিগত ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

বিষয়টি নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে গত ১৬ নভেম্বর একটি পোস্ট করেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী। তিনি বলেন, 'কোনো দেশের সরকারই পিপিপি (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) চুক্তির দলিল জনসম্মুখে প্রকাশ করবে না আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে। সরকারি ক্রয়নীতি ও পিপিপি গাইডলাইন অনুযায়ী পূর্ণ প্রকাশ নিরাপদ নয়।' সেইসঙ্গে বেসরকারি অংশীদারের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টিও জানান তিনি।

বন্দরে বিদেশি অপারেটর বাছাইয়ের আগে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা উচিত বলে মনে করেন অনেকে। এই প্রক্রিয়া মানা হয়নি বলে আসা অভিযোগেরও জবাব দেন আশিক চৌধুরী। তিনি ওই পোস্টে আরও লেখেন, 'পিপিপি নীতিমালার জিটুজি পদ্ধতির আলোকে টেন্ডার আহ্বান, প্রাক-যোগ্যতা যাচাই, টেকনিক্যাল ও ফিনান্সিয়াল মূল্যায়ন এবং ডিউ ডিলিজেন্সের মাধ্যমে অপারেটর চূড়ান্ত করা হয়েছে।'

বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তির পক্ষে সরকারের যুক্তিগুলো কী?

সরকার যুক্তি দিচ্ছে—সীমিত বন্দর সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং দক্ষতা বাড়াতেই বিশ্বমানের অপারেটর আনা হচ্ছে। দুর্নীতি ও অদক্ষতাকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বন্দরে একটি জাহাজ বার্থিংয়ের জন্য গড়ে তিন-চার দিন অপেক্ষা করে, যেখানে সিঙ্গাপুরে সময় লাগে মাত্র ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা। কনটেইনার খালাসেও ৭ থেকে-১০ দিন সময় লাগে, যা আন্তর্জাতিক মানের (২-৩ দিন) চেয়ে অনেক বেশি। বিদেশি অপারেটররা তাদের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বন্দরের এই 'টার্ন-অ্যারাউন্ড টাইম' কমিয়ে দক্ষতা বাড়াতে পারবে বলে আশা করছে সরকার।

লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য ডেনমার্কের কোম্পানিটি প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই ২৫০ কোটি টাকা 'সাইনিং মানি' পেয়েছে বাংলাদেশ। পানগাঁও টার্মিনালে সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৪৯০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। এ ক্ষেত্রে সাইনিং মানি হিসেবে তারা বাংলাদেশকে দিয়েছে ১৮ কোটি টাকা। এতে করে দেশের নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার না করে বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে অবকাঠামো তৈরি হবে। মানে, বাংলাদেশকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হবে না।

এছাড়া, সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে বলা হচ্ছে। ১৭ নভেম্বরের চুক্তি সই অনুষ্ঠানে জানানো হয়, লালদিয়া টার্মিনালে বছরে আট থেকে দশ লাখ কনটেইনার ওঠা-নামা করার সক্ষমতা থাকবে। এর মধ্যে আট লাখ পর্যন্ত প্রতি একক কনটেইনারে ২১ ডলার করে পাবে সরকার। আর আট লাখের বেশি কনটেইনার ওঠানো–নামানো হলে প্রতি একক কনটেইনারের জন্য পাবে ২১ থেকে ২৩ ডলার করে। অন্যদিকে পানগাঁও নৌ টার্মিনালে বছরে ১ লাখ ৬০ হাজার একক কনটেইনার হ্যান্ডলিং হবে বলে জানিয়েছে মেডলগ। প্রতি একক কনটেইনার থেকে ২৫০ টাকা করে পাবে সরকার।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএএ) চেয়ারম্যান সৈয়দ এম আরিফ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্থানীয় বা বিদেশি—যেই হোক, দক্ষ ও অভিজ্ঞ অপারেটরই প্রয়োজন।'

চুক্তি নিয়ে আপত্তিগুলো কী?

বাংলাদেশের অন্তত পাঁচটি টার্মিনালে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে দেওয়ার আলোচনায় জোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে বেশ কয়েকটি সংগঠন। এর মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রাম শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ), গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি, কয়েকটি বাম রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম।

তাদের প্রশ্ন, নির্বাচনের ঠিক আগে তাড়াহুড়ো করে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘমেয়াদে এতবড় কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রাখে কিনা? বাংলাদেশের জনগণের জানার অধিকার আছে—এতে দেশের স্বার্থ ও লাভ কতটা থাকবে, জাতীয় নিরাপত্তায় কোনো ঝুঁকি তৈরি হতে পারে কিনা?

সমালোচনাকারী পক্ষগুলো অভিযোগ করছে, চুক্তিগুলো সই করা হয়েছে অস্বাভাবিক দ্রুততায় এবং চুক্তির বিস্তারিত শর্তাবলী জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার 'নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট'-এর অজুহাত দেখিয়ে তথ্য গোপন রাখছে।

লালদিয়া টার্মিনালের কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব মাত্র একদিন করে মূল্যায়ন করা হয়েছে। ২০-৩০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির জন্য এ সময় যথেষ্ট নয়। আরও অভিযোগ উঠেছে, এই প্রক্রিয়ায় অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হয়নি।

অনেক সমালোচকের মতে, যে পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে, তা বাংলাদেশ নিজেই করতে পারত। সেক্ষেত্রে মাশুলের পুরোটা বাংলাদেশেরই থাকত। এখন বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দেওয়ায় সরকার মাশুলের একটি ভাগ পাবে, যা দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য অনুকূল না-ও হতে পারে।

এছাড়া, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বন্দরকে লাভজনক করতে ইতোমধ্যেই এক লাফে ৪০ শতাংশ মাশুল বাড়ানো হয়েছে, যা আমদানি পণ্যের মূল্য বাড়াবে এবং দেশের রপ্তানি সক্ষমতাকেও খর্ব করবে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিদেশি অপারেটরের নিয়ন্ত্রণে কনটেইনার চার্জ ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে।

আরেকটি বড় সমালোচনা হলো—বিদেশি অপারেটররা পরিচালনা, বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত এবং প্রবেশাধিকারসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এটি জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিদেশি কর্তৃত্বের অনুপ্রবেশ ঘটাতে পারে। দুর্বল চুক্তির কারণে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক আদালতে বিরোধ হলে বাংলাদেশকে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে হতে পারে।

বন্দর পরিচালনাকে সাধারণ কোনো বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হয় না। ডিপি ওয়ার্ল্ডের মতো বিদেশি সংস্থার হাতে নিউমুরিং টার্মিনাল দেওয়া হলে জাতীয় নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রও ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এই বিবেচনায় টার্মিনাল পরিচালনা করতে দেয়নি—এমন উদাহরণও আনছেন আপত্তিকারীরা।

চট্টগ্রামের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) দেশীয় প্রতিষ্ঠান ১৭ বছর ধরে সফল ও লাভজনকভাবে পরিচালনা করছে। এটি তার নির্ধারিত সক্ষমতার চেয়ে বেশি কনটেইনার হ্যান্ডল করছে এবং এক হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় করছে। প্রশ্ন উঠেছে, এমন একটি লাভজনক টার্মিনাল বিদেশি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে কেন?

তারওপর বিদেশি কোম্পানি তাদের বিনিয়োগে টার্মিনাল চালালে এখানকার অভিজ্ঞ কর্মীরা চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে থাকবে। এনসিটিতে ইতোমধ্যে দেশের টাকায় সব আধুনিক যন্ত্রপাতিও কেনা আছে, কিন্তু বিদেশি প্রতিষ্ঠান এলে সেগুলো ঠিকমতো ব্যবহার না হওয়ার আশঙ্কা থাকছে।

জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সাবেক সহপ্রচার সম্পাদক হুমায়ুন কবীর বলেন, বে টার্মিনাল বা লালদিয়ার মতো নতুন প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগ আনা যেতে পারে, কিন্তু এনসিটি পরিচালনায় বিদেশি অপারেটরের কোনো প্রয়োজন নেই।

তিনি জানান, এনসিটি তৈরি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) নিজস্ব অর্থে, এখানে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ তেমন নেই। এখানে বিদেশি অপারেটর এলে আয়ের বেশিরভাগই তারা নিয়ে যাবে এবং সামান্য হ্যান্ডলিং ফি দেবে।

সমালোচকরা দাবি করছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের অদক্ষতা শুধু ব্যবস্থাপনার কারণে নয়, বরং এর ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেও বটে। কর্ণফুলী নদীর সরু চ্যানেল, পানির অগভীরতা এবং জোয়ার-ভাটার পরিবর্তন বড় জাহাজ চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। নাব্যতার এই সীমাবদ্ধতা বিদেশি অপারেটরদের দিয়ে দূর করা সম্ভব না।

বন্দরের অদক্ষতার আরেকটি বড় কারণ হলো কাস্টমসে জটিলতা (৭-১০ দিন সময় লাগে) এবং অর্থনৈতিক হাবগুলোর সঙ্গে দুর্বল সংযোগ ব্যবস্থা (কানেকটিভিটি)। বিদেশি অপারেটর আনলেই কাস্টমসের সমস্যা বা সংযোগের দুর্বলতা দূর হবে না।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখানে শুধু অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন নয়; ভূরাজনীতি ও নিরাপত্তাও একটি বড় বিষয়। তার মতে, জাতীয় দক্ষতাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কোনো বেসরকারি বা বিদেশি প্রতিষ্ঠান সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রীয় সংস্থার হাতেই থাকা উচিত, বিশেষ করে দেশের প্রধান বন্দর চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে।

বিকল্প ও করণীয় সম্পর্কে প্রস্তাবনা

বিদেশি অপারেটর নিয়োগই দক্ষতা বাড়ানোর একমাত্র উপায় নয় বলে মনে করছে চুক্তির বিপক্ষে অবস্থানকারীরা। এর চেয়েও কার্যকর ও স্বল্প ব্যয়ের বিকল্পও দিয়েছে তারা।

তাদের মতে, এতবড় একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত খোলামেলা, অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের ভিত্তিতে নেওয়া উচিত, যেখানে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের পরামর্শ ও আলোচনা থাকবে। আর বন্দর পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি থাকলে সরকারের উচিত ছিল সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করার দিকে গুরুত্ব দেওয়া।

বন্দরের দক্ষতা বাড়াতে সবচেয়ে দ্রুত ও সহজ পদক্ষেপ হিসেবে তারা কাস্টমস সংস্কারের দাবি তুলছে। আধুনিক স্ক্যানার, স্বয়ংক্রিয় রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, ২৪/৭ অপারেশন এবং দক্ষ জনবল নিশ্চিত করা গেলে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সময় (৭ দিন থেকে) কমিয়ে ১-২ দিনে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।

সিঙ্গাপুরের মতো সফল বন্দর পরিচালনা রাষ্ট্রীয় তদারকির ওপর নির্ভর করে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানকেও যথাযথ তদারকির মাধ্যমে কার্যকরভাবে পরিচালনা করা সম্ভব বলে জানাচ্ছে পক্ষগুলো।

Comments

The Daily Star  | English

Victory day today: A nation born out of blood and grit

The tide of war had turned by mid-December in 1971. The promise of freedom was no longer a dream. It had hardened into tangible certainty.

7h ago