তালেবানকে ঘিরে ‘লেজেগোবরে’ ভারতের পররাষ্ট্রনীতি

মোটা দাগে হিসাব পরিষ্কার—আফগানিস্তানের মাটি থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের চলে যেতে হয়েছে লজ্জা নিয়ে। সেসময় ভারত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু। তাই ভারতকেও আফগানিস্তান ছাড়তে হয়েছিল মাথা নিচু করেই। এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে ভাটার টান। শুধু তাই নয়, দুর্গাপূজার মণ্ডপে 'দেবতা' ট্রাম্পকে দেখা গেল 'অসুর' হিসেবে। আবার ইসলামাবাদের সঙ্গে কাবুলের সম্পর্ক বেশ 'তিক্ত'। একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সংবাদ গণমাধ্যমে শিরোনাম হচ্ছে। তাই কমছে দিল্লি-কাবুলের দূরত্ব।
অন্যদিকে, আফগানিস্তানে চলছে চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য। তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি না দিয়েও কীভাবে দেদারসে ব্যবসা করা যায় তা বিশ্ববাসীকে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে কমিউনিস্ট চীন। প্রতিবেশী হলেও চীন ভারতের আরেক 'শত্রু'র নাম।
শুধু চীন নয়, একে একে সব প্রতিবেশীর ঘরেই ব্রাত্য হয়ে পড়েছে দিল্লির মোদি সরকার। এমন পরিস্থিতিতে অনেকে মনে করছেন—এক সময়ের শত্রু আফগানিস্তানের তালেবানকে এখন বন্ধু বানাতে দোষ কোথায়? তালেবান সরকারকে কোনো দেশ স্বীকৃতি না দিলেও তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে ভারত যদি তালেবানের আপাত 'শত্রু' পাকিস্তানকে 'চাপে' রাখতে পারে তাহলে মন্দ কী?
কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের ভাষ্য—যুক্তরাষ্ট্রের কাছে 'হাত পাতা' কিংবা চীনের কাছে 'মাথা ঝোঁকানো'র বিষয়টি ভারতবাসী অনেকক্ষেত্রে মানতে পারলেও তালেবানের মতো নারী অধিকারবিরোধী সংগঠনের কাছে 'নতজানু' হওয়াটা ঠিক হচ্ছে না।
'লেজেগোবরে' পররাষ্ট্রনীতি
একটু ফিরে দেখা যাক। ইউক্রেনে আগ্রাসনের কারণে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমের দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা দিলে তা আমলে নিতে গররাজি ছিল ভারত। নিজ দেশের জনগণকে সস্তায় তেল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাশিয়া থেকে ভারত প্রচুর তেল কিনতে শুরু করে। দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে আসে পরিবর্তন। ভারসাম্যের কথা বলে ক্রমশ ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।
অবস্থা এমন পর্যায়ে ঠেকে যে সস্তায় রুশ তেল কেনার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে ভারতবাসীকে। ট্রাম্প-শুল্কে বিদ্ধ হচ্ছে ভারতের ব্যবসায়ী মহল আর কারখানার শ্রমিক-কর্মচারী তথা আমজনতা। এক সময়ের 'মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড' ট্রাম্পকে নিয়ে ভীষণ নীরব নরেন্দ্র মোদি ও তার সরকার। তবে সরব জনতা। তাই গেল পূজায় ট্রাম্পকে দেখা গেল 'অসুর' রূপে।

যা হোক, হোয়াইট হাউসের আচরণে নাখোশ ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির চাপে নরেন্দ্র মোদিকে মুখ ফেরাতে হয় বেইজিংয়ের দিকে। কিন্তু, তাতে খুব একটা সুবিধা যে হয়নি বর্তমান পরিস্থিতি দেখেই বলে দেওয়া যায়। সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদি লাল গালিচা সম্বর্ধনা পাওয়ায় অনেকে মন্তব্য করেছিলেন¬—১৯৬০ এর দশকের 'হিন্দি-চিনি ভাই ভাই' স্লোগান আবার ফিরছে। বাস্তবতা হচ্ছে, সেই আওয়াজ হাওয়ায় মেলাতে সময় লাগেনি।
এরপর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে হাত বাড়াতে হয় আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের দিকে। বলা হয়, সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আগ্রহী নয়াদিল্লি। মোদিপন্থি বিশ্লেষকরা বলতে শুরু করেন—প্রতিবেশী আফগানিস্তানের মাটি কোনো একক দেশের হাতে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। সেই একক দেশ বলতে তারা মূলত চীনকেই বোঝান। এরপর যোগ হয় পাকিস্তান-কাণ্ড। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বুঝতে পারে পাকিস্তানকে চাপে রাখতে তাদের তালেবানকে প্রয়োজন।
কারও কারও মতে, আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের দীর্ঘ বিরোধপূর্ণ সীমান্তের কারণে দুই দেশের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য করে তোলা গেলে তাতে নাকি আখেরে নয়াদিল্লিরই লাভ। কেননা, এর মাধ্যমে ইসলামাবাদকে কাবুল নিয়ে ব্যস্ত রাখা যাবে।
আসলে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার জন্য নিজের নাক কাটতে গেলে দিন শেষে যে নিজেরই ক্ষতি হয়—তা দেখা গেল গত ১১ অক্টোবর—কন্যাশিশু দিবসে। দিল্লির দূতাবাসে বসে তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলবি আমির খান মুত্তাকি সংবাদ সম্মেলন করলেন নারী সাংবাদিকদের বাদ দিয়ে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানালো—এ বিষয়ে তাদের কিছু করার নেই। সেই সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেওয়া পুরুষ সাংবাদিকরাও এর প্রতিবাদ করলেন না। বিরোধীদের সরব প্রশ্ন—তালেবানদের কাছে নয়াদিল্লি এত নতজানু কেন? শুধুমাত্র পাকিস্তানকে শায়েস্তা আর আফগানিস্তানে চীনের ব্যবসায় ভাগ বসানোর জন্যই কী নয়াদিল্লিকে এতটা নিচে নামতে হচ্ছে?

কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধি বললেন, ভারতীয় সমাজে নারীরা হচ্ছে মেরুদণ্ড। তারা এই দেশের অহংকার। তৃণমূল নেত্রী মহুয়া মৈত্র বললেন, মোদি সরকার দেশের সব নারীকে অপমান করলেন। তিনি বিজেপির 'নারী শক্তি' স্লোগানকে ভণ্ডামি বলতেও ছাড়েননি।
কারও মুখে শোনা গেল এমন প্রশ্নও—দিল্লিতে কি তালেবানি শাসন শুরু হলো?
কেউ কেউ আরও একধাপ এগিয়ে যেন বলতে চান—ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এখন এতটাই 'লেজেগোবরে' যে নিজ দেশেও নারী অধিকারকে সমুন্নত রাখার ইচ্ছাটুকুও প্রকাশ করতে পারছে না দেশটির 'বেটি বাঁচাও' কর্মসূচি দেওয়া ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা।
Comments