অনেক নজিরই গড়লেন মামদানি, কিন্তু আসল চ্যালেঞ্জ কী?
নিউইয়র্ক সিটির নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি নানা কারণেই আলোচনায়। ১৮৯২ সালের পর থেকে শহরের সবচেয়ে তরুণ মেয়র হিসেবে তিনি দায়িত্ব নেবেন। এ ছাড়া তিনি শহরের প্রথম মুসলিম মেয়র এবং আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া প্রথম মেয়রও বটে।
চলতি বছর জুনে নিউইয়র্কের মেয়র পদের প্রার্থী বেছে নিতে প্রাইমারির আয়োজন করে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। তখন তার পরিচিতি প্রায় শূন্যের কোঠায় ছিল। প্রচারণার তহবিলও ছিল খুবই সীমিত। দলীয় সহায়তাও তেমন ছিল না। এরপরও তিনি সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো এবং রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়াকে হারিয়ে দিয়েছেন।
বড় বিষয় হলো, তিনি সেই ধরনের রাজনীতিবিদ, যেমনটি বহু বছর ধরে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বামপন্থীরা খুঁজছিলেন। তার বয়স মাত্র ৩৪, সুদর্শন এবং সোশ্যাল মিডিয়াতেও তিনি বেশ সাবলীল।
তার জাতিগত পরিচয় দলের মধ্যকার বৈচিত্র্যই তুলে ধরে। তিনি কোনো রাজনৈতিক লড়াই এড়িয়ে যাননি এবং গর্বের সঙ্গে বামপন্থী নীতি সমর্থন করেছেন— যেমন বিনামূল্যে শিশুর যত্ন, ভালো গণপরিবহন ব্যবস্থা এবং মুক্তবাজার ব্যবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ ইত্যাদি।
মামদানি তার প্রচারণায় এমনটা বোঝাতে পেরেছেন যে তিনি সেই শ্রমজীবী ভোটারদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয়গুলোতে পুরো মনোযোগ দিতে পারবেন, যারা ডেমোক্র্যাট পার্টি থেকে দূরে সরে গেছেন।
সমালোচকরা আগেই বলেছিলেন, আমেরিকার মতো দেশে এই ধরনের প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য নন। রিপাবলিকানরা তাকে পার্টির চরম-বামপন্থী মুখ হিসেবে উপস্থাপন করেন। তারপরও মঙ্গলবার রাতে নিউইয়র্কে তিনি মেয়র পদে জয়ী হন।
মামদানি সাবেক গভর্নর কুয়োমোকে হারিয়ে পুরোনো ডেমোক্র্যাটিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। অনেক বামপন্থী মনে করেন, এই ব্যবস্থা দল ও দেশের বাস্তবতা থেকে অনেকটা দূরেই ছিল।
এসব কারণে মেয়র পদে মামদানির প্রচারণা মিডিয়ার ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করে। এর অর্থ হলো, মেয়র হিসেবে তার সাফল্য এবং ব্যর্থতা নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করা হবে।
১২ বছর আগে ডেমোক্র্যাট বিল দে ব্লাসিও নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে জিতেছিলেন অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। মামদানির মতো তখনও মার্কিন বামপন্থীরা আশা করেছিলেন, দে ব্লাসিও এমন এক প্রশাসন গড়ে তুলবেন, যা সারা দেশের জন্য সফল উদারনীতির উদাহরণ হবে।
কিন্তু আট বছর পর দে ব্লাসিও জনপ্রিয়তা হারিয়ে মেয়র পদ ছাড়েন। তার মেয়াদকালে কিছু সাফল্য থাকলেও সীমিত ক্ষমতার কারণে তিনি নতুন নীতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হন। মামদানিকেও এখন সেই একই সীমাবদ্ধতা ও প্রত্যাশার মুখোমুখি হতে হবে।
নিউইয়র্কের বর্তমান গভর্নর ও একই দলের রাজনীতিক ক্যাথি হোকুল এরইমধ্যে জানিয়েছেন, মামদানির উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যে পরিমাণ কর বাড়ানো প্রয়োজন, তিনি তার বিরোধী। এমনকি পর্যাপ্ত অর্থ থাকলেও, মামদানি এককভাবে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারবেন না।
তিনি প্রচারণায় নিউইয়র্ক সিটিকে ঘিরে থাকা সেই করপোরেট ও ব্যবসায়ী অভিজাত শ্রেণির কড়া সমালোচনা করেন, যাদের কারণে ম্যানহাটন আজ বিশ্বের আর্থিক রাজধানী। তবে কার্যকরভাবে প্রশাসন চালাতে হলে মামদানিকে সেই স্বার্থগোষ্ঠীর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সমঝোতায় আসতে হবে এবং গত কয়েক সপ্তাহে তিনি সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছেন বলেও মনে করা হচ্ছে।
মামদানি গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডেরও নিন্দা করেছেন এবং বলেছেন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যদি নিউইয়র্কে আসেন, তবে তাকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হবে। মেয়র হিসেবে তার মেয়াদকালে এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সুযোগও আসতে পারে।
তবে এসব চ্যালেঞ্জ পরে আসবে। আপাতত মামদানির সামনে মূল কাজ হলো, নিজেকে জনপরিসরে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা, এর আগে যেন প্রতিপক্ষরা তার পরিচয় ঠিক করে না দেয়। যদিও তার প্রচারণা জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে, তবুও এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় অংশের কাছে মামদানি এক অচেনা নাম।
সিবিএসের এক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ৪৬ শতাংশ আমেরিকানই নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচন 'একেবারেই মনোযোগ দিয়ে' অনুসরণ করেননি। এই পরিস্থিতি মামদানি ও মার্কিন বামপন্থীদের জন্য যেমন এক সুযোগ, তেমনি এক বড় চ্যালেঞ্জও।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ রক্ষণশীল নেতারা নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানিকে 'বিপজ্জনক সমাজতন্ত্রী' হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করবেন। তারা দাবি করবেন, নতুন মেয়রের নীতিমালা ও অগ্রাধিকারগুলো আমেরিকার বৃহত্তম শহরকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে এবং এসব নীতি জাতীয় পর্যায়ে নেওয়া হলে দেশকেও বিপদে ফেলবে।
তারা মামদানির সামান্য ভুলও বড় করে দেখাবেন এবং প্রতিটি নেতিবাচক অর্থনৈতিক সূচক বা অপরাধের পরিসংখ্যান প্রচার করে তাকে দুর্বল প্রমাণের চেষ্টা করবেন।
নিউইয়র্কের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকা ট্রাম্পও মামদানির সঙ্গে রাজনৈতিক লড়াইকে স্বাগত জানাবেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তার হাতে নবনির্বাচিত মেয়রের কাজকে জটিল করে তোলার বহু উপায়ও রয়েছে।
অন্যদিকে মামদানিকে নিজের দলে থাকা শীর্ষ ডেমোক্র্যাট নেতাদেরও আস্থা অর্জন করতে হবে। যেমন নিউইয়র্কের সিনেটর ও সিনেটের সংখ্যালঘু নেতা চাক শুমারের কথা বলা যেতে পারে, যিনি কখনোই তার প্রচারণায় সমর্থন দেননি।
তবে মামদানির জন্য ইতিবাচক দিক হলো, তার অতীত রাজনৈতিক বিতর্ক তেমন নেই। প্রচারণার সময় বিরোধীরা তার অতীতকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করলেও তাতে সফল হয়নি।
আগামী জানুয়ারিতে শপথ নেওয়ার পর মামদানির সামনে সুযোগ থাকবে একেবারে নতুন করে নিজের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি গড়ে তোলার। আর যদি ট্রাম্প তার সঙ্গে সংঘাতে জড়ান, তাহলে সেটি বরং মামদানির জন্য বড় পরিসরে নিজেকে তুলে ধরার মঞ্চ তৈরি করবে।
মামদানির রাজনৈতিক দক্ষতা ও সামর্থ্য তাকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এটা তার জন্য বড় অর্জন। তবে আগামী কয়েক বছর যে কঠিন পরীক্ষা তার জন্য অপেক্ষা করছে, তার তুলনায় এটি সামান্যই।
নিউইয়র্কের মানুষ মনে করে, তাদের শহরই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা—এক কথায়, 'বিশ্বের কেন্দ্র'। যদিও নিউইয়র্কের নির্বাচন প্রচুর আলোচনায় ছিল, সেদিন অনুষ্ঠিত অন্য অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনগুলোও হয়তো অনেক বেশি স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে, বর্তমানে আমেরিকার ভোটাররা কী ভাবছেন বা কোন দিকে ঝুঁকছেন।
একই দিনে নিউ জার্সি ও ভার্জিনিয়া—দুটি অঙ্গরাজ্যে গভর্নর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গত বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যেখানে ডেমোক্র্যাট কমলা হ্যারিস অল্প ব্যবধানে ট্রাম্পকে হারিয়েছিলেন। এবার দুটি অঙ্গরাজ্যেই ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা আরও স্বাচ্ছন্দ্যে জিতেছেন। ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ওই ভোটারদের সমর্থন আনার মূল কারণ ছিল। কিন্তু এবার তা কাজে লাগেনি।
শেরিল ও স্প্যানবার্গার প্রতিদ্বন্দ্বিতার কৌশল ছিল মামদানির চেয়ে ভিন্ন। তাদের নীতি ছিল তুলনামূলকভাবে সংযমী। অবশ্য তারা তিনজনই ভোটারদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে তুলে ধরেছেন জীবনযাত্রার খরচ ও সাশ্রয়ী বিষয়গুলো। এক্সিট পোল দেখিয়েছে, ভোটাররা অর্থনীতি নিয়েই বেশি চিন্তিত।
মঙ্গলবার ডেমোক্র্যাটদের বামপন্থী ও মধ্যমপন্থী প্রার্থীরা জয়ী হওয়ায় দলের ভবিষ্যৎ নীতি ও প্রার্থী নির্বাচন কিছুটা জটিল হয়ে পড়বে। কেননা ভোটারদের আসল মনোভাব এখন পুরোপুরি বোঝা সহজ নয়।
তবুও মামদানি এরইমধ্যে বলেছেন, দলে সব ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির জন্য জায়গা আছে। তিনি বলেন, দল এমন হওয়া উচিত, যেখানে আমেরিকানরা শুধু কয়েকজন রাজনীতিকের প্রতিচ্ছবি নয়, বরং নিজেদেরও দেখতে পারে।
'আমার কাছে মনে হয়, যে বিষয়টি আমাদের সবাইকে একত্রিত করে, তা হলো আমরা শ্রমজীবী মানুষের জন্য লড়াই করছি।' মামদানির এই দৃষ্টিভঙ্গির পরীক্ষা হবে আগামী বছর, যখন দেশব্যাপী ডেমোক্র্যাটরা কংগ্রেসের মধ্যমেয়াদি নির্বাচনের প্রার্থীদের বেছে নেবেন। তখন রাজনৈতিক চাপ বেড়ে যাবে এবং পুরনো বিভাজন আবারও দেখা দিতে পারে।


Comments