ইসরায়েলের রাকেফেত কারাগার: সূর্যের আলো পৌঁছায় না যে মৃত্যুকূপে
গাজা থেকে আটক অন্তত ডজনখানেক ফিলিস্তিনি নাগরিককে মাটির নিচে তৈরি কারাগারে বন্দি রেখেছে ইসরায়েল। পর্যাপ্ত খাবার ও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ তো দূরের কথা, এই বন্দিরা বঞ্চিত হচ্ছেন সূর্যের আলো থেকেও।
ইসরায়েলের পাবলিক কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চার (পিসিএটিআই) এর আইনজীবীদের বরাতে আজ শনিবার এসব তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান।
তেল আবিবের দক্ষিণ-পূর্বে রামলা অঞ্চলে অবস্থিত ভূগর্ভস্থ এই কারাগারটির নাম রাকেফেত। এখানে আটকদের মধ্যে অন্তত দুজন সাধারণ নাগরিক। তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ গঠন করা হয়নি। এমনকি বিচার প্রক্রিয়াও শুরু হয়নি।
দুজনের একজন ৩৪ বছর বয়সী এক নার্স। তিনি আটক হওয়ার সময় হাসপাতালের পোশাক পরা ছিলেন। আরেকজন ১৮ বছর বয়সী তরুণ খাবার বিক্রেতা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আটকাবস্থায় থাকা এ দুজনকেই প্রতিনিধিত্ব করছেন পিসিএটিআইয়ের আইনজীবীরা।
ইসরায়েলের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ অপরাধীদের রাখার জন্য ১৯৮০'র দশকের শুরুতে খোলা হয়েছিল রাকেফেত কারাগারটি। তবে কয়েক বছর পরই এটিকে 'অমানবিক' আখ্যা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এরপর ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার পর ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভিরের নির্দেশনায় কারাগারটি পুনরায় চালু হয়।
এই কারাগারের সেল, ছোট একটি ব্যায়াম করার জায়গা এবং আইনজীবীদের সাক্ষাতের ঘর—সবকিছুই ভূগর্ভে অবস্থিত, ফলে বন্দিদের কোনো ধরনের প্রাকৃতিক আলো ছাড়াই জীবন কাটাতে হচ্ছে।
১৯৮৫ সালে বন্ধ হওয়ার সময় রাকেফেতে বন্দি ছিলেন মোট ১৫ জন। কিন্তু দেশটির সরকারি তথ্যে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রায় ১০০ জন ব্যক্তিতে এখানে আটক রাখা হয়েছে।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম এবং সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে বেন-গাভির বলেছিলেন, রাকেফেত পুনরায় চালু করা হচ্ছে ইসরায়েলে গণহত্যা চালানো 'নুখবা' (হামাসের এলিট যোদ্ধা) ও লেবাননের হিজবুল্লাহর বিশেষ বাহিনীর সদস্যদের বন্দি রাখার জন্য।
তবে আইনজীবীরা সেপ্টেম্বরে দুজনের সঙ্গে সাক্ষাতে জানতে পারেন, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে হাসপাতালে কাজে থাকা অবস্থায় আটক হন ৩৪ বছর বয়সী ওই নার্স। কিশোর খাবার বিক্রেতাকে একটি ইসরায়েলি চেকপোস্ট থেকে আটক করা হয় ২০২৪ সালের অক্টোবরে।
পিসিএটিআই আইনজীবী জানান আবদু বলেন, 'আমরা যে দুজন বন্দির সঙ্গে দেখা করেছি, তারা বেসামরিক নাগরিক। আমি যার সঙ্গে কথা বলেছি, তিনি ছিলেন ১৮ বছর বয়সী একজন খাবার বিক্রেতা। রাস্তার একটি চেকপোস্ট পার হওয়ার সময় তাকে তুলে নেওয়া হয়।'
এ বিষয়ে ইসরায়েলি প্রিজন সার্ভিস (আইপিএস) রাকেফেতে আটক অন্য বন্দিদের পরিচয় ও অবস্থান সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেনি।
গত সেপ্টেম্বরের অনুসন্ধানে দ্য গার্ডিয়ান ইসরায়েলের কিছু গোপন নথির সন্ধান পেয়েছিল। সেই সব নথি থেকে জানা যায়, যুদ্ধ চলাকালীন গাজায় আটককৃত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে প্রতি চার জনের তিন জনই বেসামরিক নাগরিক।
২০১৯ সালে ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়, ভবিষ্যত আলোচনার জন্য ফিলিস্তিনিদের মরদেহ রেখে দেওয়া আইনসম্মত।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, একইভাবে ইসরায়েল জীবিত বন্দিদেরও 'বিনিময়ের হাতিয়ার' হিসেবে ব্যবহার করছে।
এর আগে, গত অক্টোবরে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতির ফলে গাজা থেকে আটক ১ হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেয় ইসরায়েল। এদের কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ গঠন করা হয়নি। পাশাপাশি আদালতে দোষী সাব্যস্ত ২৫০ ফিলিস্তিনি বন্দিকেও মুক্তি দেওয়া হয়।
তবে যুদ্ধ চলাকালীন ইসরায়েলের আটক অভিযানের ব্যাপকতা এতটাই ছিল যে, মুক্তির পরও অন্তত ১ হাজার ফিলিস্তিনি বিভিন্ন কারাগারে বন্দিদশায় জীবন কাটাচ্ছেন।
পিসিএটিআই বলছে, 'আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শেষ হলেও গাজাবাসী এখনো যুদ্ধকালীন অবস্থার মতোই বন্দি রয়েছেন। যা স্পষ্টত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন ও নির্যাতনের শামিল।'
পিসিএটিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক তাল স্টেইনার জানান, সবগুলো কারাগারেই 'ইচ্ছাকৃতভাবে ভয়াবহ' অবস্থায় রাখা হয়েছে বন্দি ফিলিস্তিনিদের। তবে রাকেফেত কারাগারটি এক বিশেষ ধরনের নির্যাতনের প্রতীক। মাসের পর মাস কোনো মানুষকে মাটির নিচে সূর্যের আলোর সংস্পর্শ ছাড়া রাখা হলে তা মানসিকভাবে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে।
স্টেইনার বলেন, 'এমন দমনমূলক পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে ঠিক থাকা অত্যন্ত কঠিন।' সেই সঙ্গে শারীরিক স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে। ভিটামিন ডি উৎপাদন ও ঘুমের জন্য প্রয়োজনীয় সার্কাডিয়ান রিদমের মতো মৌলিক জৈবিক কার্যক্রমগুলো ব্যাহত করে।
রামলার কারাগারে যাতায়াত থাকলেও এই মৃত্যুকূপের মতো অমানবিক কারাগারটি সম্পর্কে জানতেন না স্টেইনারও। আশির দশকের মাঝামাঝি ইসরায়েল প্রিজন সার্ভিসের প্রধান রাফায়েল সুইসার আত্মজীবনী ঘেঁটে রাকেফেত সম্পর্কে জানতে পারে পিসিএটিআই।
স্টেইনার বলেন, 'সুইসা লিখেছিলেন যে, ২৪ ঘণ্টা মাটির নিচে আটকে রাখা যেকোনো মানুষের জন্যই অসহনীয় পর্যায়ের। এটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও অমানবিক।'
চলতি গ্রীষ্মে ওই দুই বন্দির পক্ষে মামলা গ্রহণ করতে গেলে জানান আবদু ও তার আরেক সহকর্মী সাজা মিশেরকি বারানসি প্রথমবারের মতো রাকেফেতে যান।
কারাগারের মুখোশ পরা ভারী অস্ত্রধারী প্রহরীদের সঙ্গে নোংরা সিড়ি বেয়ে নিচে নামেন দুই আইনজীবী। সেখানে পোকামাকড়ের মৃতদেহ পড়ে ছিল। টয়লেট এতোটাই অপরিষ্কার ছিল যে ব্যবহার করার যোগ্য নয়।
আইনজীবীরা বন্দিদের সঙ্গে কথা বলার সময়ও সার্ভেইলেন্স ক্যামেরা দিয়ে নজরদারি অব্যাহত ছিল। যা মৌলিক মানবাধিকার ক্ষুণ্ন করে। এমনকি আইনজীবীদের প্রহরীরা সতর্ক করে দেন এই বলে, পরিবার বা গাজার যুদ্ধ নিয়ে কথা বললে তাৎক্ষণিকভাবে সাক্ষাৎ বন্ধ করে দেওয়া হবে।
আবদু বলেন, 'আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, যদি আইনজীবী হিসেবে আমাদের অবস্থাই এমন অপমানজনক হয়, তাহলে এখানকার বন্দিদের অবস্থা কেমন হতে পারে? যার উত্তর বন্দিদের দেখামাত্রই পেয়ে গিয়েছিলাম।' হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বন্দিদের মাথা নিচু করে আনা হয়, প্রহরীরা জোর করে তাদের মাথা মাটির দিকে ঠেলে রাখছিলেন।
বারানসি জানান, ইসরায়েলি বিচারকরা ভিডিও শুনানিতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তাদের আটকাদেশ অনুমোদন করেন। রাকেফেতে বন্দিদের জানালা ও বাতাসহীন সেলে তিন-চারজন করে রাখা হয়। নিয়মিত শারীরিক নির্যাতন, লোহার মুখোশ পরা কুকুর দ্বারা হামলা, প্রহরীদের পায়ের নিচে পিষ্ট হওয়া, অপর্যাপ্ত চিকিৎসা ও প্রায় না খাইয়ে রাখার মতো নির্যাতনের শিকার হন বন্দিরা।
দিনের বেলা বন্দিদেরে সেলের বাইরে বের হওয়ার সময়ও সীমিত। সেটিও ভূগর্ভস্থ একটি ছোট জায়গায় প্রায় দুই দিন পর পর মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য। প্রতিদিন ভোর ৪টার দিকে বিছানার গদি সরিয়ে নেন প্রহরীরা। তা ফেরত দেওয়া হয় গভীর রাতে। এই সময়ে বন্দিদের ঘুমাতে হয় শুধুমাত্র লোহার খাটে।
বন্দিদের বর্ণনা টেলিভিশনে প্রচারিত বেন-গাভিরের রাকেফেত সম্পর্কিত বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়। রাকেফেত নিয়ে বেন-গাভির বলেছিলেন, 'সন্ত্রাসীদের স্বাভাবিক জায়গা—মাটির নিচে।'
আটক নার্স সবশেষ সূর্যের আলো দেখেছিলেন গত ২১ জানুয়ারি। ওইদিন তাকে রাকেফেতে আনা হয়। তার তিন সন্তান রয়েছে, যাদের কোনো খবর আটক হওয়ার পর থেকে পাননি নার্সটি। বারানসি বলেন, 'যখন আমি তাকে জানাই যে "তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলেছি, তিনিই আমাকে অনুমতি দিয়েছেন," তখন অন্তত তাকে এইটুকু জানাতে পারি যে তার মা জীবিত আছেন।'
আইনজীবী আবদুকে ১৮ বছর বয়সী ওই বন্দি বিক্রেতা জানান, 'আটকের পর আপনিই প্রথম মানুষ, যাকে আমি দেখতে পেলাম।' তিনি জানতে চান তার অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রী সন্তান জন্ম দিয়েছেন কি না! এই প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই প্রহরী কথোপকথন থামিয়ে দেন। আবদুর কাছে কিশোরটির শেষ অনুরোধ ছিল, 'দয়া করে আবার আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।'
বন্দিদের নিয়ে যাওয়ার সময় আবদু লিফটের শব্দ শুনতে পান বলে জানান। যা ইঙ্গিত দেয় তাদের সেল মাটির আরও গভীরে।
অবশ্য আইপিএস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আইন অনুযায়ী সরকারি তত্ত্বাবধানে সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে। আইনি প্রক্রিয়া, বন্দিদের রাখা বা গ্রেপ্তারের নীতির জন্য তারা দায়ী নন।


Comments