মোদিকে নিয়ে যা বলেছেন মামদানি
বিদেশের মাটিতে কোনো ভারতীয় বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তির সাফল্যে সাধারণত শুভেচ্ছা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বলা বাহুল্য, এতে একদিকে যেমন ভারতের মুখ উজ্জ্বল হয়, অন্যদিকে দেশ-বিদেশের সব বিষয়ে ভারতীয় সরকার প্রধানের নজর আছে—তাও তুলে ধরা যায়।
কিন্তু, প্রখ্যাত মার্কিন-ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক মীরা নায়ার ও নিউইয়র্কের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির গুজরাটি শিক্ষাবিদ মাহমুদ মামদানির ছেলে জোহরান মামদানির নিউইয়র্ক-জয়ে বেশ নীরব দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে।
গত ৭ নভেম্বর সিএনএন'র এক প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হয়—নিউইয়র্কের মেয়র ভারতের গর্ব। কিন্তু সে ব্যক্তি একইসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর তীব্র সমালোচক।
এতে বলা হয়, নিউইয়র্কে প্রথম দক্ষিণ এশীয় মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়লেন জোহরান মামদানি। বিজয়-ভাষণে তিনি ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সময় জাতির উদ্দেশে দেওয়া দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি দিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি মঞ্চ মাতালেন বলিউডের 'ধুম মাচালে' গানের সুরে।
নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর ইসলামবিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়েছিল যে শহরে সেখানে ভারতীয় বংশোদ্ভূত পরিবারের মুসলিম সন্তানের বিজয় ছিল অভিবাসনবিরোধী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি ভোটারদের বৃদ্ধাঙ্গুলি। ট্রাম্প এক সময় ছিলেন মোদির 'প্রিয় বন্ধু'। এখন 'চক্ষুশূল'। তারপরও জোহরান মামদানির বিজয়ে নীরব কেন নরেন্দ্র মোদি?
জোহরান মামদানির বিজয়-উল্লাসের ঢেউ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৮ হাজারেরও বেশি মাইল দূরে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারতে এসে পড়েছে। তবে তার পূর্বপুরুষের দেশটিতে জোহরান মামদানির সমালোচকও আছেন অনেক। যেহেতু জোহরান মামদানি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তীব্র সমালোচক সেহেতু মোদিভক্তরা কি জোহরানের বিজয়ে নাখোশ?
নিউজার্সির ড্রিউ ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক সহযোগী অধ্যাপক সানগে মিশ্র সিএনএন'কে বলেন, জোহরান মামদানির বিজয় 'ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে।' তবে, নির্বাচনের সময় তার রাজনৈতিক পরিচয় ও আদর্শ সামনে চলে আসে। সে সময় দেখা যায়, জোহরান মামদানি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিজেপি সরকার ও তাদের হিন্দুত্ববাদী প্রচারণার বিরুদ্ধে সব সময়ই উচ্চকণ্ঠ।
জোহরান মামদানির 'আদি-নিবাস'
নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানির মা 'সালাম বোম্বে!'-খ্যাত চিত্রপরিচালক মীরা নায়ার। ১৯৮৮ সালে ফ্রান্সে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্র অস্কার মনোনয়ন ও কান উৎসবে কামেরা দ'অর পুরস্কার পায়। ১৯৫৭ সালে ভারতের উড়িষ্যায় জন্ম নেওয়া মীরা নায়ার দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন। পরে তিনি বৃত্তি নিয়ে যান হার্ভাডে।
১৯৮৯ সালে বিশ্বখ্যাত এই নির্মাতা উগান্ডায় 'মিসিসিপি মাসালা' চলচ্চিত্রের গবেষণার সময় সেখানকার ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাহমুদ মামদানির সঙ্গে পরিচিত হন। ১৯৯১ সালে তাদের বিয়ে হয়। সেই বছরই জন্ম নেন জোহরান মামদানি।
জোহরান মামদানির বাবা মাহমুদ মামদানির জন্ম ১৯৪৬ সালে, ভারতের মুম্বাইয়ে। তার মা-বাবা ছিলেন গুজরাটি মুসলিম। পরে মাহমুদ মামদানি পরিবারের সঙ্গে বেড়ে ওঠেন উগান্ডার রাজধানীর কাম্পালায়। ১৯৭২ সালে উগান্ডার তৎকালীন একনায়ক ইদি আমিনের নির্দেশে সে দেশ থেকে প্রায় ৬০ হাজার এশীয়কে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। মাহমুদ মামদানি ছিলেন তাদের একজন। তখন তার বয়স ছিল বিশের কোঠায়।
১৯৭৪ সালে মাহমুদ মামদানি হার্ভাড থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি তাঞ্জানিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় শিক্ষকতা করেন। বর্তমানে মাহমুদ মামদানি নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।
'গুড মুসলিম, ব্যাড মুসলিম: আমেরিকা, দ্য কোল্ড ওয়ার, অ্যান্ড দ্য রুটস অব টেরর' বইয়ের জন্য মাহমুদ মামদানির বিস্তৃত খ্যাতি আছে। উপনিবেশবাদ ও রাজনৈতিক সংঘাতের ওপর বিশেষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই লেখককে আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ হিসেবে গণ্য করা হয়।
জোহরান মামদানির 'নরেন্দ্র মোদি ও হিন্দুত্ববাদ' বিরোধিতা
সিএনএন'র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শহর ও বিশ্ববাণিজ্যের রাজধানী হিসেবে খ্যাত নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র তার নিজ শহরের পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে নিয়মিত নিজের ভাবনা প্রকাশ করেন। আগের মেয়ররা সাধারণত তাদের শহর থেকে হাজার মাইল দূরে কোনো দেশ নিয়ে তেমন মন্তব্য করতেন না।
এতে আরও বলা হয়, জোহরান মামদানি তার পূর্বপুরুষের দেশ ভারতের রাজনীতি ও সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজখবর ভালোই রাখেন। ২০০২ সালে গুজরাট রাজ্যে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা নিয়ে জোহরান মামদানি বিভিন্ন সময় সরব হয়েছেন। তিনি বিভিন্ন সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা করেছেন।
বিজেপির বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন, সংবিধান থেকে ভারতশাসিত জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ-ব্যবস্থা তুলে নেওয়াসহ দেশটিতে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে সবসময় সরব সুদূর নিউইয়র্কে থাকা জোহরান মামদানি।
২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় সেই রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন জোহরান মামদানি। শুধু তাই নয় মোদিকে 'যুদ্ধাপরাধী' বলে আখ্যাও দিয়েছিলেন তিনি। সরকারি হিসাবে, সেই দাঙ্গায় এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন। তাদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান।
এমন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মোদিভক্তরা বা হিন্দুত্ববাদকে যারা নিজেদের আদর্শ হিসেবে মানেন তারা জোহরান মামদানির ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত। তারা যেন নরেন্দ্র মোদির হয়ে জোহরান মামদানিকে জবাব দিয়ে যাচ্ছেন।
বিজেপির মুখপাত্র সঞ্জু ভার্মা সমাজমাধ্যম এক্স-এ জোহরান মামদানিকে 'মিথ্যাবাদী' ও 'হিন্দুবিদ্বেষী' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
একই কারণে বিজেপির লোকসভা সদস্য ও বলিউড অভিনেত্রী কঙ্গণা রানাউত এই মার্কিন রাজনীতিককে ভারতের শত্রু 'পাকিস্তানের মুখপাত্র' বলে গালি দিয়েছেন।
তার মতে, জোহরান মামদানির ধমনীতে হিন্দুর রক্ত থাকলেও তিনি তা মুছে ফেলার চেষ্টা করছেন।


Comments