মাদুরোকে ‘সাদ্দাম’ ভাবছেন ট্রাম্প?

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নিকোলাস মাদুরো। অলঙ্করণ: স্টার গ্রাফিক্স
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নিকোলাস মাদুরো। অলঙ্করণ: স্টার গ্রাফিক্স

যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলার মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার হলেও এই দুই দেশকে প্রতিবেশী বলা যায়। কেননা, দুই দেশেরই অবস্থান আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিম পাড়ে।  দুইটি দেশই বৃহত্তর আমেরিকা মহাদেশের অংশ।

কিন্তু, বন্ধু হওয়ার পরিবর্তে শত্রুতায় জড়ালো কেন দেশদুটির সরকার? আর কেনই বা ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি নিকোলাস মাদুরো হয়ে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের মহাশক্তিধর রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের চক্ষুশূল?

২০১৩ সালে ভেনেজুয়েলার শাসক উগো চাবেসের মৃত্যুর পর নিকোলাস মাদুরো দেশটির রাষ্ট্রপতি হন। ২০১৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মাদুরো নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে—পরের বছর অর্থাৎ, ২০১৯ সালে ভেনেজুয়েলার আইন পরিষদ সংবিধান পরিবর্তন করে এবং মাদুরো জোর করে ক্ষমতা দখল করেন।

২০১৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ ৫০টির বেশি দেশ নিকোলাস মাদুরোকে ভেনেজুয়েলার বৈধ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মানতে নারাজ।

২০২৪ সালের জুলাইয়ে ভেনেজুয়েলায় রাষ্ট্রপতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনেও ক্ষমতা ধরে রাখেন মাদুরো। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সেই নির্বাচনে মাদুরোকে আইনসঙ্গতভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে মানতে অস্বীকার করে।

ভেনেজুয়েলার শাসক নিকোলাস মাদুরো। ফাইল ছবি: রয়টার্স
ভেনেজুয়েলার শাসক নিকোলাস মাদুরো। ফাইল ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ—মাদুরোর সরকার ভেনেজুয়েলার মাদক চোরাকারবারিদের দমন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ক্ষমতায় বসে মাদুরো কলম্বিয়ার বামপন্থি বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী এফএআরসি-কে সঙ্গে নিয়ে 'মাদক সন্ত্রাস' শুরু করেছে। মাদুরো নিজে টনকে টন মাদক হন্ডুরাসসহ অন্য দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। তিনি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা করছেন বলেও অভিযোগ তুলছে ওয়াশিংটন।

নিকোলাস মাদুরোকে ধরতে যুক্তরাষ্ট্র পুরস্কার হিসেবে ৫০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে মাদক সংক্রান্ত অপরাধে এটিই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থের পুরস্কার।

মাদুরোকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। ছবি: সংগৃহীত
মাদুরোকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। ছবি: সংগৃহীত

মাদক ও মাদুরো

সিএনএন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়—ডোনাল্ড ট্রাম্প মাদক সন্ত্রাসের দায় চাপিয়ে ভেনেজুয়েলার মাদুরোর ওপর যতই চাপ সৃষ্টি করছেন মার্কিন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তারা ততই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। তাদের ভাষ্য, ভেনেজুয়েলার সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিতে মাদককে অজুহাত হিসেবে খাড়া করছেন ট্রাম্প।

তারা বলছেন, ভেনেজুয়েলার সেনাদের সঙ্গে মাদক চোরাচালানকে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। অথবা, মাদক চোরাকারবারিদের সঙ্গে ভেনেজুয়েলার সেনাদের জড়ানো হচ্ছে। অনেকের মতে, গোয়েন্দা সংস্থা ও মাদক দমন সংস্থার দুর্বল গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ট্রাম্প প্রশাসন এগোচ্ছে। তারা মনে করেন, বিষয়টি 'পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত'।

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, ভেনেজুয়েলা ও মেক্সিকোর চোরাকারবারিরা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে মাদক পাচার করছে।

ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসে আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের এক গবেষক ফিল গানসন সিএনএন-কে বলেন, 'মাদক চোরাকারবারিদের বিষয়ে যেসব কথা প্রচার করা হচ্ছে বাস্তবে এর অস্তিত্ব নেই। সাংবাদিকদের বারবার বলা হচ্ছে যে ভেনেজুয়েলার সরকার মাদক চোরাচালানে জড়িত।'

সম্প্রতি, ভেনেজুয়েলার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিয়োসদাদো কাবেলো বলেছেন, 'হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্র মাদক চোরাকারবার প্রসঙ্গে কথা বলছে। তাদের হাতে কোনো প্রমাণ নেই। কারণ, এরকম কিছুরই অস্তিত্ব নেই। এটি উপনিবেশিক শক্তির বয়ান মাত্র।'

এ দিকে, মাদক চোরাচালানে নিজের সংশ্লিষ্টতার সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মাদুরো। তার সরকারের পক্ষ থেকেও বারবার বলা হচ্ছে যে তারা চোরাকারবারিদের সঙ্গে জড়িত নয়।

মাদুরো কি ট্রাম্পের 'সাদ্দাম'?

ভেনেজুয়েলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বেশ জটিল। দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশের জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এর সংঘাত মূলত তেল, রাজনীতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে।

ট্রাম্প প্রশাসন ভেনেজুয়েলার মাদক চোরাকারবারিদের ওপর নিয়মিত হামলা চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। ট্রাম্পও চাচ্ছেন ভেনেজুয়েলায় অভিযান চালিয়ে দেশটির শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করতে।

ইরাকের প্রয়াত শাসক সাদ্দাম হোসেন। ফাইল ছবি: রয়টার্স
ইরাকের প্রয়াত শাসক সাদ্দাম হোসেন। ফাইল ছবি: রয়টার্স

গত ২ সেপ্টেম্বর ভেনেজুয়েলার একটি নৌযানে মার্কিন সেনারা হামলা চালিয়ে ১১ জনকে হত্যা করে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। ভেনেজুয়েলায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য হামলা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।

এমন পরিস্থিতিতে ভেনেজুয়েলার তেল সম্পদের প্রসঙ্গটি বেশি করে সামনে চলে আসে।

গত ৪ সেপ্টেম্বর আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভেনেজুয়েলায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি খনিজ তেল আছে। ২০২৩ সালের হিসাবে ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল তেল মজুত আছে সেখানে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সৌদি আরবের আছে ২৬৭ বিলিয়ন ব্যারেল এবং ২০৮ বিলিয়ন ব্যারেল তেলের মজুত নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে ইরান।

সেই হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের মজুদ আছে ৫৫ বিলিয়ন ব্যারেল। বৈশ্বিক হিসাবে দেশটির অবস্থান নবম। যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ভেনেজুয়েলায় তেলের মজুদ পাঁচ গুণের বেশি।

ভেনেজুয়েলার মূল আয় তেল বিক্রি থেকে আসলেও বর্তমানে তা কমে গেছে। এ প্রসঙ্গে ইরাকের কথা মনে করা যেতে পারে। গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে—এমন অভিযোগ নিয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্র বাহিনী ২০০৩ সালে ইরাকের ওপর আগ্রাসন চালায়। পরে জানা যায়, ইরাকে সে ধরনের অস্ত্র নেই এবং সেখানে মার্কিন হামলার মূল লক্ষ্য ছিল তেল-গ্যাসের খনিগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া।

হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

সেসময় আরও একটি ঘটনা ঘটেছিল। তা হলো: ইরাকের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেন হয়ে উঠেছিলেন তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশের 'চক্ষুশূল'। সেসময় যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় ছিল রিপাবলিকান পার্টি। এবারও তারাই ক্ষমতায়। তাহলে মাদুরোকে কি দক্ষিণ আমেরিকার 'সাদ্দাম' হিসেবে বিবেচনা করছে ট্রাম্প প্রশাসন?

একটি 'অভিযোগ'কে সামনে এনে পুরোমাত্রার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে মার্কিন সেনারা? ইতোমধ্যে তারা ভেনেজুয়েলার প্রতিবেশী ত্রিনিদাদ ও টোবাগোয় সামরিক মহড়াও সেরে নিয়েছে। তবে এসবের পাশাপাশি মাদুরোর সঙ্গে কথা বলার আগ্রহও প্রকাশ করেছেন ট্রাম্প। আগামী দিনে পরিস্থিতি কোনদিকে যায় এখন যেন তাই দেখার বিষয়।

 

Comments

The Daily Star  | English

Victory Day: Nation honours Liberation War martyrs

The government has taken extensive programmes to celebrate the day

1h ago