ব্ল্যাক ফ্রাইডে: বিশৃঙ্খলার একদিন রূপান্তরিত হলো কেনাকাটার উৎসবে
'ব্ল্যাক ফ্রাইডে' এখন সবার মুখে মুখে। বছরের এই দিনে বিভিন্ন ব্র্যান্ড গ্রাহকদের জন্য আকর্ষণীয় ছাড় ঘোষণা করে। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে এর পরিচিতি ছিল খুব কম, কিন্তু এখন দেশেও এই ট্রেন্ড ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
মানুষ বিভিন্নভাবে এই দিন উদযাপন করছে, বিশেষ করে শপিংয়ে। শোরুম, অনলাইন স্টোর এবং সোশ্যাল মিডিয়ার পেজগুলোতে 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে' সেলের অফার দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ সচেতনভাবে এই উৎসবে অংশ নিচ্ছেন, আবার অনেকে অজান্তেই ছাড়ের সুযোগ উপভোগ করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে থ্যাংকসগিভিং এর পরের দিনটিকে বলা হয় 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে'। ছুটির মৌসুমের কেনাকাটা, বছরের সবচেয়ে বড় ছাড় এবং বিশ্বায়নের প্রভাব মিলিয়ে দিনটি এখন বৈশ্বিক উৎসবে পরিণত হয়েছে।
ভয়েস অব আমেরিকা জানায়, থ্যাংকসগিভিং যুক্তরাষ্ট্রের উৎসবমুখর একটি দিন। ঐতিহাসিকভাবে এটি আমেরিকান আদিবাসীদের প্রথম ফসল ঘরে তোলার উৎসব। এটি অনেকটা বাংলাদেশের নবান্ন উৎসবের মতো। নতুন ফসল ঘরে তোলা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং পরিবার–পরিজনের সঙ্গে সময় কাটানোর সংস্কৃতি এখন দিনটির মূল আচার। আর এই ছুটির আবহ তৈরি করে ব্ল্যাক ফ্রাইডের কেনাকাটার উন্মাদনার মঞ্চ।
ব্ল্যাক ফ্রাইডের শুরু
অনেকেই ভাবেন যে ব্যবসায়ীরা বছরের পুরো সময় লোকসানে থাকে। ব্রিটানিকার দেওয়া তথ্যমতে, এই লোকসানকে লাল রঙ দিয়ে বোঝানো হয়। আর থ্যাংকসগিভিংয়ের পরদিন ব্যাপক কেনাকাটার কারণে তারা কালোতে ফিরে আসে। অর্থাৎ লাভে ফিরে আসে। এই ব্যাখ্যা জনপ্রিয় হলেও ইতিহাসের সঙ্গে এর সম্পর্ক কম।
ব্রিটানিকা জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার পুলিশ ১৯৬০-এর দশকে প্রথম 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে' শব্দটি ব্যবহার করে। সেদিন শহরের প্রতিটি অলিগলি এমনকি দূরদূরান্ত থেকেও অনেক মানুষ কেনাকাটা করতে আসে। তাদের আকর্ষণের আরেক কেন্দ্রবিন্দু ছিল বার্ষিক আর্মি–নেভি ফুটবল ম্যাচ।
এই বিশাল জনস্রোত আর বিশৃঙ্খলা পুলিশের জন্য দিনটিকে বিভীষিকাময় করে তোলে। তবে ব্যবসায়ীরা এই বিরক্তিকর ধারণা দূর করতে দিনটিকে 'বিগ ফ্রাইডে' নাম দিতে চেয়েছিলেন। সেটি প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে' নামটাই থেকে যায়।
খুচরা বিক্রেতাদের নতুন রূপান্তর
খুচরা ব্যবসায়ীরা এই নেতিবাচক নামটিকেই ইতিবাচক ঘটনায় রূপান্তর করে ১৯৮০-এর দশকে। তারা ওই 'রেড-টু-ব্ল্যাক' তত্ত্বটি ছড়িয়ে দেয়। আর ধীরে ধীরে ব্ল্যাক ফ্রাইডে আমেরিকায় ছুটির কেনাকাটার উন্মাদনা দিন হয়ে ওঠে।
বিজনেস ইনসাইডারের জানায়, বিক্রির দিক থেকে সবচেয়ে বড় কেনাকাটার দিনটি প্রায়ই বড়দিনের আগের শনিবার, কিন্তু লোক সমাগমে ব্ল্যাক ফ্রাইডে এখনো শীর্ষেই।
থ্যাংকসগিভিংয়ের তারিখ বদল
ব্ল্যাক ফ্রাইডের শুরুর আগেই ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলো বড়দিনের সাজসজ্জায় ঝলমল করতো। আর বিজ্ঞাপন আসতো থ্যাংকসগিভিংয়ের পরদিন। ১৯৩৯ সালে নভেম্বর মাসে পাঁচটি বৃহস্পতিবার থাকায় থ্যাংকসগিভিং পড়েছিল মাসের শেষ দিনে, ফলে ক্রিসমাস শপিংয়ের সময় কমে যায়।
ব্রিটানিকা জানিয়েছে, ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকার সরকার ছুটির দিন এক সপ্তাহ এগিয়ে ২৩ নভেম্বর ঠিক করে। দুই বছর পর কংগ্রেস আইন করে দেয় যে, থ্যাংকসগিভিং হবে নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবারে। আজও সেটিই চালু আছে।
যুদ্ধোত্তর আমেরিকার কেনাকাটার বিস্তার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উদারনীতিবাদী অর্থনীতির প্রভাবে প্রচুর দোকানপাট গড়ে ওঠে। একই সময়ে শপিং মলের উদ্ভব ঘটে। এতেই আমেরিকার ভোক্তা সংস্কৃতি আরও ফুলেফেঁপে ওঠে।
বড়দিনের সাজসজ্জা নভেম্বরের প্রথম দিকেই দোকানগুলোতে দেখা যেতে শুরু করে। ব্ল্যাক ফ্রাইডে আর শুধু আমেরিকার ঘটনা নয়। ইউরোপ, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে পণ্যে বড় ছাড় এখন পরিচিত ঘটনা।
বিশৃঙ্খলা সামলানো একদিন থেকে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত কেনাকাটার দিনে রূপ নেওয়া ব্ল্যাক ফ্রাইডে তাই অর্থনীতি ও ভোক্তা অভ্যাস বদলে দিয়েছে। আর এই বদলে যাওয়ার যাত্রার অংশ এখন পুরো বিশ্ব।
বিবিসি বিশ্বব্যাপী ব্ল্যাক ফ্রাইডে জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছে। অনলাইন শপিংয়ের অভ্যাস ক্রেতাকে সহজেই অফার সম্পর্কে জানায়।
থ্যাংকসগিভিং বা নভেম্বরের কেনাকাটার মনস্তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে ব্র্যান্ডগুলো বড়সড় মূল্যছাড় দিতে পারছে। পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারণা দিনটিকে উৎসবধর্মী আবহ দিয়েছে।


Comments