বার্লিনের ‘মামদানি’ হতে চান তুর্কি আলিফ

জার্মানির ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট পার্টি ডি লিঙ্কের সদস্য আলিফ আরালপ। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
জার্মানির ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট পার্টি ডি লিঙ্কের সদস্য আলিফ আরালপ। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

আলিফ আরালপ। তুর্কি বংশোদ্ভূত। জার্মানির ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট পার্টি ডি লিঙ্কের সদস্য। আগামী বছর অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে বার্লিন শহরের মেয়র প্রার্থী তিনি। নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র উগান্ডায় জন্ম নেওয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত জোহরান মামদানি তার প্রেরণা।

জোহরান মামদানির মতো আলিফ আরালপও বার্লিনবাসীর নিত্যদিনের সমস্যাগুলো সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। নগরীর আবাসন সংকট, চলাফেরায় বাড়তি খরচ, এমনকি, ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধও তার নির্বাচনী প্রচারণায় প্রাধান্য পাচ্ছে।

গত ২৩ নভেম্বর ইসরায়েলের প্রভাবশালী দৈনিক হারেৎজ-এর এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়—'এই নারী হতে চান বার্লিনের জোহরান মামদানি'।

প্রতিবেদনে বলা হয়—আলিফ আরালবের বক্তব্য পরিষ্কার। নিউইয়র্কের মতো বিশ্বসেরা শহর যদি সমাজবাদী মেয়র নিতে পারে তাহলে বার্লিনও পারবে। গত ৪ নভেম্বর নিউইয়র্কের মেয়র পদে জোহরান মামদানির বিজয়ের পর শুভেচ্ছা বার্তায় এই জার্মান রাজনীতিক তার ইনস্টাগ্রামে লিখেন 'নিউইয়র্ক থেকে বার্লিন: জেগে উঠছে বামধারা।'

ভিডিও বার্তায় আলিফ আরালপ বলেন, 'আপনার বিজয় আগামী বছর বার্লিনের মেয়র প্রচারণায় প্রেরণা হয়ে থাকবে।'

বামপন্থি দল ডি লিঙ্কের রাজনীতিক আলিফ বার্লিন আইনসভার সদস্য। এবার তিনি বার্লিনের মেয়রপ্রার্থী।

জার্মানির ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট পার্টি ডি লিঙ্কের সদস্য আলিফ আরালপ। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
জার্মানির ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট পার্টি ডি লিঙ্কের সদস্য আলিফ আরালপ। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, আগামী বছর সেপ্টেম্বরে বার্লিনবাসী তাদের স্থানীয় আইনসভার নির্বাচনে ভোট দেবেন। সেই আইনসভায় নির্বাচিত হবেন সেই মহানগরীর মেয়র বা মহা-নাগরিক।

গত বছরও মনে হয়েছিল জার্মানিতে বামধারা বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু, আলিফ আরালবের আকস্মিক আবির্ভাব রক্ষণশীল দলের মেয়র কাই ভাগনারকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। অর্থাৎ, বার্লিনের ক্ষমতাসীন ডানপন্থি ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নের নেতা কাই ভাগনারকে চ্যালেঞ্জ করছেন বামপন্থি ডি লিঙ্কের নেতা আলিফ আরালপ।

সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, জনপ্রিয়তার নিরিখে আলিফ আরালপ দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন। প্রথম অবস্থানে আছেন কাই ভাগনার। তিনি এগিয়ে আছেন মাত্র তিন পারসেনটেজ পয়েন্ট বেশি জনপ্রিয়তা নিয়ে।

হারেৎজ-প্রতিবেদনে আরও বলা হয়—ঠিক এক বছর আগেও বার্লিনে এমন চিত্র কল্পনা করা যায়নি। গত বছর নভেম্বরে জার্মানির ক্ষমতাসীন জোট যখন ভেঙে যায়, তখন দেখা গেল বার্লিনের আইনসভা থেকে বামেরা বিলুপ্ত হওয়ার পথে।

গত জানুয়ারিতে চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্জ উগ্র ডানপন্থি অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ডের (এএফডি) সমর্থন নিয়ে কেন্দ্রীয় আইনসভায় অভিবাসনবিরোধী আইন পাস করে। তার এমন উদ্যোগ জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এতে বাড়তি রাজনৈতিক সুবিধা পায় বামপন্থিরা।

শুধু তাই নয়, গত ফেব্রুয়ারির ফেডারেল নির্বাচনে দাই লিনক-এর পক্ষে ভোট পড়ে নয় শতাংশ। সারাদেশে দলটির নতুন সদস্য হয়েছে বেশ কয়েক হাজার। এখন বামেরা বার্লিন জয়ের স্বপ্ন দেখছে। যেমনটি দেখেছিলেন জোহরান মামদানি।

জার্মান রাজনীতিবিদ আলিফ আরালপ। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
জার্মান রাজনীতিবিদ আলিফ আরালপ। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

মিউনিখে আলিফ আরালবের জন্মের অল্পদিন আগে তার তুর্কি সমাজবাদী মা-বাবা জার্মানিতে আসেন রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হয়ে। জোহরান মামদানির মতো আলিফ আরালপও অভিবাসী। জার্মানির মাটিতে আলিফ আরালপকে বহু বছর জাতিবিদ্বেষের শিকার হয়ে হয়েছে। জোহরান মামদানির মতো আলিফও এসব বিষয় তার নির্বাচনী আলোচনায় নিয়ে আসছেন।

আলিফ আরালপ বার্লিনের আবাসন সমস্যা দূর করতে চান। তিনি চান নগরীর সরকারি পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি করতে। তিনি সেখানকার ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার খরচ কমাতে চান।

'বিরক্ত বার্লিনবাসী'

দীর্ঘদিন ধরে বার্লিনবাসী প্রচলিত পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থায় বিরক্ত। একসময় যে শহরে জীবনযাত্রার খরচ ছিল সহনীয়, এখন তা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। মিউনিখ ও ফ্রাঙ্কফুর্টের মতো ব্যস্ত ব্যয়বহুল শহরগুলোর তুলনায় শান্ত রাজধানীতে বাড়িভাড়া একটু কম হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তা অনেক বেড়েছে।

গত পাঁচ বছরে জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। মিউনিখ ও ফ্রাঙ্কফুর্টের বাসিন্দাদের তুলনায় বার্লিনবাসীর গড় আয় অনেক কম। তাই আলিফ আরালপ নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়রের মতো বার্লিনবাসীদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। জোহরান মামদানি তার এমন প্রচারণায় সুফল পেয়েছেন, তাই আলিফ আরালপও সেই পথে এগোতে চান। তবে এখনো বার্লিনের অনেকে আলিফকে চেনেন না।

দলের সদস্যদের সঙ্গে আলিফ আরালপ। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
দলের সদস্যদের সঙ্গে আলিফ আরালপ। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

চলতি বছরের শুরুতে জার্মানির ফেডারেল নির্বাচনে বামপন্থি দলের যোগাযোগ কৌশল তৈরিতে সহায়তা করা লিজা ফ্লুম গণমাধ্যমেকে বলেছেন, 'ক্ষমতাবানদের এক হাত দেখে নেওয়া জোহরান মামদানি খুব বড় পদের নেতা ছিলেন না। তিনি পুরোটা সময় শ্রমজীবীদের কাছে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তিনি সবার মধ্যে আশা ছড়িয়ে দিয়েছেন।'

লিজা সবে নিউইয়র্ক থেকে বার্লিনে ফিরেছেন। সেখানে তিনি ও তার সহকর্মীরা দেখেছেন যে তাদের দল কিভাবে জোহরান মামদানির নির্বাচনী কৌশল থেকে শিক্ষা নিতে পারে। তিনি দেখেছেন যে সেখানে প্রচারণা ছিল খুবই নিয়মমাফিক।

লিজার ভাষ্য, 'মামদানি তিনটি প্রধান বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি তিনটি বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ও সমাজমাধ্যম পোস্টে এসব বার্তা প্রচার করা হতো। তারা নির্বাচনী প্রচারণায় মানুষজনকে এমনভাবে নিয়োজিত করেছিলেন যা আমরা জার্মানিতে এখনো পর্যন্ত করে দেখাতে পারিনি।'

বার্লিনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রগ্রেসিভস জেনট্রুম-এর রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোহানা সেইবার্ত গণমাধ্যমকে বলেন, 'ডানপন্থিদের শাসনব্যবস্থার ওপর জনগণ বিরক্ত। জোহরান মামদানি দেখিয়েছেন, প্রথাবিরোধী বক্তব্য নিয়ে জনগণের কাছে যেতে হবে। তাদেরকে সুন্দর ভবিষ্যৎ দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এই বিষয়গুলোই জার্মানির বামপন্থি দল খুব কাছে থেকে দেখার চেষ্টা করেছে।'

লিজা বিশ্বাস করেন যে আলিফ আরালপ বার্লিনবাসীর দৈনন্দিন জীবনের সংকটগুলো কাটানোর চেষ্টা করবেন। তিনি তাদেরকে ন্যায়ভিত্তিক সমাজে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিবেন। এগুলো তার বিজয় নিশ্চিত করবে।

আলোচনায় ইসরায়েল-গাজা

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের সশস্ত্র যোদ্ধারা ইসরায়েলে হামলা চালালে প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েলি সেনারা গাজায় গণহত্যা চালায়। এমন পরিস্থিতিতে জার্মানির বামপন্থি দল ডি লিঙ্কে নীতিগতভাবে কী অবস্থান নেবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে। ইউরোপে সবচেয়ে বেশি ফিলিস্তিনি বাস করে বার্লিনে। স্বভাবতই সেখানে উত্তেজনা ছিল অনেক বেশি। সেসময় ইহুদিবিদ্বেষ মোকাবিলায় খুব জোরালো ভূমিকা না রাখার অভিযোগও উঠেছিল দলটির বিরুদ্ধে। এমন অভিযোগ নিয়ে দল ছাড়েন অনেকে।

সম্প্রতি দলটির বার্লিন সম্মেলনে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা ও ইসরায়েল-বর্জন আন্দোলনের প্রসঙ্গ উঠে আসে। দলটি ইসরায়েলের 'যুদ্ধাপরাধ' ও 'মানবতাবিরোধী অপরাধ'-এর নিন্দা করে।

দলীয় সম্মেলনে আলিফ আরালপ বলেছিলেন, 'এক পক্ষের দুঃখকষ্টের কথা বলে আরেক পক্ষের দুঃখকষ্টের কথা ভুলে যাওয়া যাবে না।' গাজা থেকে বার্লিনে আসা ফিলিস্তিনিদের পরিবারের কারো সঙ্গে বার্লিনের মেয়র কাই ভাগনার দেখা করেননি বলেও অভিযোগ তুলেন আলিফ। ধর্মীয় কারণে কাউকে আঘাত করা গ্রহণযোগ্য নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বক্তব্য রাখছেন আলিফ আরালপ। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
বক্তব্য রাখছেন আলিফ আরালপ। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

আলিফ বলেন, 'ইউরোপে সবচেয়ে বেশি ফিলিস্তিনির বাস বার্লিনে। আবার এখানে ইহুদিরাও ফিরছেন। তাই টুপি পরার কারণে কাউকে আঘাত করা গ্রহণযোগ্য নয়।'

বার্লিনে ভোটারদের সরাসরি ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন না। দলের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে বার্লিন আইনসভায় যান। সেখানে আইনপ্রণেতারা মেয়র নির্বাচিত করেন। বামেরা যদি বেশি ভোট পায় তাহলে তারা গ্রিন পার্টি ও সমমনা মধ্য-বামপন্থি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের নিয়ে জোট করতে পারবে। তখন বামপন্থিদের জন্য মেয়র পদ পাওয়া সহজ হবে।

সম্প্রতি, জার্মান সংবাদমাধ্যম দ্য মিউনিখ আই-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আলিফ আরালপকে বাম দলের প্রার্থী করা হয়েছে। তিনি বার্লিনের মেয়র ভাগনারের সঙ্গে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামছেন। আলিফ আরালবের মনোনয়ন বার্লিনের বাম দলের জন্য রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তার হাত ধরে বার্লিনের বাম দল পরিবর্তনের ডাক দিতে চায়।

Comments