ভারতে স্মার্টফোনে সরকারি অ্যাপ: গণনজরদারি নিয়ে উদ্বেগের মুখে বাতিল

ছবি: রয়টার্স

ভারত সরকার নতুন সব স্মার্টফোনে সরকারি মালিকানাধীন একটি সাইবার নিরাপত্তা অ্যাপ 'সঞ্চার সাথী' প্রি-ইনস্টল করার নির্দেশ দিয়েছিল। তবে এই পদক্ষেপকে নাগরিকদের ব্যক্তিগত ডিভাইসে সরকারি নজরদারির চেষ্টা হিসেবে দেখার কারণে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। অবশেষে গতকাল বুধবার প্রবল আপত্তির মুখে সরকার নির্দেশটি বাতিল করেছে।

গতকাল বুধবার ভারত সরকারের এই উদ্যোগ নিয়ে বিস্তারতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এর আগে দেশটির টেলিযোগাযোগ বিভাগ (ডিওটি) ২৮ নভেম্বর একটি সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করে।

ওই বিজ্ঞপিতে  অ্যাপল, স্যামসাংসহ সব প্রধান স্মার্টফোন নির্মাতাকে বলা হয়—নতুন তৈরি সব ডিভাইসে ৯০ দিনের মধ্যে 'সঞ্চার সাথী' অ্যাপটি যোগ করতে হবে। ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন সরকারের যুক্তি ছিল, মোবাইল ফোন জালিয়াতি ও অপব্যবহার রোধ করতেই এই পদক্ষেপ।

তবে প্রযুক্তি কোম্পানি এবং ডিজিটাল অধিকারকর্মীরা এটি ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন হিসেবে দেখেছিলেন। আদেশ প্রত্যাহারের আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাপল জানিয়েছিল, গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যার কারণে তারা নির্দেশ মানবে না।

নির্দেশে কী বলা হয়েছিল?

ভারতের টেলিযোগাযোগ বিভাগের জারি করা নির্দেশে নির্মাতাদের বলা হয়েছিল, ভারতে ব্যবহারের জন্য তৈরি বা আমদানি করা সব মোবাইল হ্যান্ডসেটে ৯০ দিনের মধ্যে 'সঞ্চার সাথী' অ্যাপ প্রি-ইনস্টল করতে হবে।

আরও বলা হয়েছিল, অ্যাপটি প্রথমবার ডিভাইস চালুর সময় ব্যবহারকারীর কাছে সহজে দৃশ্যমান ও প্রবেশযোগ্য থাকতে হবে এবং কোনোভাবেই নিষ্ক্রিয় বা সীমাবদ্ধ করা যাবে না।

যে ডিভাইসগুলো ইতোমধ্যে বাজারে রয়েছে, সেগুলোতেও সফটওয়্যার আপডেটের মাধ্যমে অ্যাপটি সরবরাহ করার জন্য নির্মাতা ও আমদানিকারকদের 'চেষ্টা চালাতে' বলা হয়েছিল।

এছাড়া ১২০ দিনের মধ্যে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ পালনের প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।

পরিসংখ্যান ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন মন্ত্রণালয়ের মে মাসের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতের ৮৫ শতাংশের বেশি পরিবার স্মার্টফোন ব্যবহার করে।

সরকার কেন এই নির্দেশ জারি করেছিল?

নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে সরকার বলেছিল,

টেলিকম সাইবার সিকিউরিটি রুলস অনুযায়ী সম্ভাব্য সাইবার ঝুঁকি শনাক্ত ও রিপোর্ট করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা তাদের আছে।

'সঞ্চার সাথী' অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা আন্তর্জাতিক মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি (আইএমইআই) সংক্রান্ত সন্দেহজনক অপব্যবহার রিপোর্ট করতে পারবেন। সেইসঙ্গে মোবাইল ডিভাইসে ব্যবহৃত আইএমইআই নম্বর যাচাই করতে পারবেন।

আইএমইআই হলো একটি ১৫ অঙ্কের ইউনিক নম্বর, যা নির্দিষ্ট একটি মোবাইল ডিভাইসকে শনাক্ত করে।

স্মার্টফোন নির্মাতাদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

রয়টার্সের কাছে একটি সূত্র জানায়, অ্যাপল ভারত সরকারকে বুঝিয়ে বলবে যে তারা বিশ্বের কোনো দেশেই এ ধরনের নির্দেশ মানে না।

আরেকটি সূত্র জানায়, দক্ষিণ কোরিয়া–ভিত্তিক স্যামসাং নির্দেশটি পর্যালোচনা করছে। তবে তারা কীভাবে এগোবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানায়নি।

সমালোচনাগুলো কী?

ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশন (আইএফএফ) এক বিবৃতিতে এটিকে 'ব্যক্তিগত ডিজিটাল ডিভাইসের ওপর নির্বাহী নিয়ন্ত্রণের উদ্বেগজনক সম্প্রসারণ' বলে উল্লেখ করেছে। তারা এই পদ্ধতিকে অসম্পূর্ণ, আইনগতভাবে দুর্বল এবং ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা ও স্বাধীনতার পরিপন্থী মনে করে।

ভারতের লোকসভায় কংগ্রেস নেত্রী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী এটিকে 'গোপনে নজরদারির অ্যাপ' এবং 'হাস্যকর' বলে মন্তব্য করেন।

দিল্লিভিত্তিক সফটওয়্যার ফ্রিডম ল' সেন্টারের মতে, এই নির্দেশ ব্যবহারকারীর স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার চেষ্ট এবং '২৪ ঘণ্টা রাষ্ট্র আমার ঘরে' নীতির আরেকটি উদাহরণ। তাদের মতে, সরকারের কোনো অধিকার নেই নাগরিকদের ডিভাইসে প্রবেশ করার।

২০২০ সালে করোনার সময় সরকার 'আরোগ্য সেতু' নামে একটি অ্যাপ বাধ্যতামূলক করার সময়ও একইরকম বিতর্ক উঠেছিল। সমালোচকেরা তখন এটিকে 'গোপনীয়তার জন্য বিস্ফোরক ফাঁদ' বলে বর্ণনা করেছিলেন।

ভারত কখন এই নির্দেশ প্রত্যাহার করল?

'প্রাপ্ত প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে' নির্দেশটি সংশোধন করতে প্রস্তুত ভারত সরকার। গতকাল গতকাল বুধবার সকালে এমন কথা জানিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওই নির্দেশটি প্রত্যাহার করা হয়।

ভারতের যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, মোবাইল নির্মাতাদের জন্য প্রি-ইনস্টল বাধ্যতামূলক না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বিবৃতিতে এটাও যোগ করা হয়, নিরাপদ এবং সাইবার জগতের খারাপ ব্যক্তিদের হাত থেকে নাগরিককে রক্ষা করাই অ্যাপটির উদ্দেশ্য।

নির্দেশ প্রত্যাহার প্রসঙ্গে আইএফএফ জানায়, এটি অবশ্যই একটি ভালো সিদ্ধান্ত। তবে তারা এখনো নির্দেশ প্রত্যাহারের পূর্ণ আইনি নথি দেখার অপেক্ষায় আছে।

অন্যান্য দেশ কি এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে?

এ বছর শুরুর দিকে রাশিয়া 'ম্যাক্স' নামে একটি অ্যাপ চালু করে। এটি চুরি হওয়া ফোন প্রতারণায় ব্যবহারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা এবং সরকার-সমর্থিত ডিজিটাল সেবায় প্রবেশের সুযোগ দেবে বলা হয়।

রুশ কর্তৃপক্ষ দাবি করে, 'ম্যাক্স' বিদেশি প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাপগুলোর চেয়ে বেশি সুরক্ষিত।

রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ভিকে-র তৈরি 'ম্যাক্স' অ্যাপটি সরকারি প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সংযুক্ত। এটি ১ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ায় বিক্রি হওয়া সব নতুন ফোনে বাধ্যতামূলক।

তবে সমালোচকেরা বলছেন, এই অ্যাপ নজরদারির জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। যদিও মস্কো তা অস্বীকার করেছে।

এর আগে আগস্টে রাশিয়া হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামে ভয়েস কল সীমাবদ্ধ করার ঘোষণা দেয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, এসব প্ল্যাটফর্মের ভয়েস সেবা ব্যবহার করে রুশ নাগরিকদের 'জিম্মি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত' করা হচ্ছে। আর বিদেশি সামাজিকমাধ্যম কোম্পানিগুলো সরকারের অনুরোধ উপেক্ষা করছে।

Comments

The Daily Star  | English

Victory day today: A nation born out of blood and grit

The tide of war had turned by mid-December in 1971. The promise of freedom was no longer a dream. It had hardened into tangible certainty.

7h ago