দক্ষিণ এশিয়ায় তুরস্ক-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতার প্রভাব কতটুকু?

তুরস্ক পাকিস্তান সম্পর্ক
ইসলামাবাদে তুরস্ক-পাকিস্তানের জ্বালানি চুক্তিতে উপস্থিত দুই দেশের কর্মকর্তারা। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

ঘটনাটা ঘটেছে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে। চলতি মাসের শুরুতে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা দেখা গেল না। তবে স্থানীয় গণমাধ্যমে ঘটনাটির পাশাপাশি এর সুদূর প্রভাবের কথাও বলা হয়েছে।

ঘটনাটি হলো তুরস্ক ও পাকিস্তান ভারত মহাসাগরে নিজেদের উপস্থিতি জোরালোভাবে জানান দেওয়ার জন্য চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুসারে, টার্কিশ পেট্রোলিয়াম বা টিপিএও পাকিস্তানের জলসীমায় তিনটি ব্লকে ও ভূখণ্ডে দুইটি ব্লকে তেল-গ্যাস খুঁজবে। দেশ দুটি খনিজ ও বিদ্যুৎ-খাতে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বাড়াতে রাজি হয়েছে।

গত ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি দৈনিক ডন জানায়, তুরস্কের জ্বালানিমন্ত্রী আলপারসলান বেরাকতারের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল ইসলামাবাদ এসেছিল। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, সেনাপ্রধান আসিম মুনির, পেট্রোলিয়ামমন্ত্রী আলি পারভেজ মালিক ও বিদ্যুৎমন্ত্রী আওয়াইস লেঘারির সঙ্গে তুর্কি কর্মকর্তারা দেখা করেন।

ওই ঘটনায় পাকিস্তানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের আগ্রহ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে দেশটির সমুদ্রসীমায় তথা ভারত মহাসাগরে প্রভাব বাড়াতে ইসলামাবাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আছে।

সংবাদ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৪ সালে তুরস্ক ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিল ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। অথচ, ২০২২ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রেসিপ এরদোয়ান তিন বছরের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৫ বিলিয়ন ডলার করতে রাজি হয়েছিলেন। ২০২১ সালে এই বাণিজ্য ছিল ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের।

এমন বাস্তবতায় পশ্চিম এশিয়ার দেশ তুরস্ক আশা করছে দক্ষিণ এশিয়ার মিত্র পাকিস্তানকে নিয়ে পুরো অঞ্চলে তাদের প্রভাব বাড়াবে। তারা এই অঞ্চলের দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব বিস্তারকারী ভারত ও তার পশ্চিমা মিত্রদের আধিপত্যে ভাগ বসাবে।

পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে—তুরস্ক ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধের ওপর ভিত্তি করে। ২০২২ সালে দেশ দুটির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপিত হয়। এরপর থেকে তা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে দেখা যাচ্ছে।

প্রতিবেদন অনুসারে—পাকিস্তানের উপকূলে তুরস্কের তেল-গ্যাস খোঁজার কাজ দিন শেষে ব্যর্থ হলেও এই সংক্রান্ত দুই দেশের চুক্তি ইতোমধ্যে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আলো ফেলেছে। এটি আঙ্কারা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের মুকুটে নতুন পালক যোগ করেছে। এই দেশ দুটি তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল।

তবে সেই ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে—তুরস্কের পণ্য সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জার্মানি, নেদারল্যান্ড ও আফগানিস্তানে। আবার তুরস্কে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি হয় চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও কাতার থেকে।

গত ১২ ডিসেম্বর জ্বালানি খাতে ইসলামাবাদ-আঙ্কারার সাম্প্রতিক চুক্তি নিয়ে তুরস্কের দৈনিক সাবাহ-এর এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়, 'তুরস্ক-পাকিস্তানের সহযোগিতা বিস্তৃত হয়ে ভারত মহাসাগরে পৌঁছেছে'। এতে বলা হয়, চুক্তিগুলো বাস্তবায়নে খরচ হবে ৩০০ মিলিয়ন ডলার।

এ ছাড়াও, এসব চুক্তির গুরুত্ব যে সুদূর প্রসারী সে কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, পাকিস্তানের জলসীমায় আঙ্কারা শুধুই যে তেল-গ্যাস খুঁজতে যাচ্ছে, বিষয়টি তা নয়। এমন ইঙ্গিতে অনেকের মনে সামরিক খাতে তুরস্ক-পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতার কথা মনে পড়ে যেতে পারে।

প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়, বিশ্বমঞ্চে মাঝারি শক্তির দেশগুলো আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে নিজেদের অবস্থানে পরিবর্তন আনছে। বৈশ্বিক জ্বালানি ব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন আসায় সেই প্রতিযোগিতায় এসব মাঝারি ক্ষমতার দেশগুলোও অংশ নিতে চায়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বৃহৎ শক্তিগুলোর পাশে নিজেদের অস্তিত্ব জানিয়ে দিতে চায় অপেক্ষাকৃত ছোট অর্থনীতির দেশগুলোও। অর্থাৎ, ধরে নেওয়া যেতে পারে যে ভারত মহাসাগরকে ঘিরে তুরস্ক-পাকিস্তান ক্রমশই উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠছে।

আরও পরিষ্কার করে বললে, তুরস্ককে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ অর্থনীতির দেশ ভারতকে টক্কর দিতে চায় প্রতিবেশী পাকিস্তান। আর আঙ্কারা চায় দক্ষিণ এশিয়ায় জ্বালানি খাতে তার শক্তি-সামর্থ্য বাড়াতে। অন্যদিকে, নিজেদের উপকূলে খনিজের খোঁজে এতদিন ধরে যে অবহেলা চলছিল ইসলামাবাদ তা ঘুচাতে চায়।

বদলে যাচ্ছে ভারত মহাসাগরের দৃশ্যপট?

ফিরে আসা যাক দৈনিক সাবাহ-এর সেই প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, পাকিস্তানের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক যখন জোরদার হচ্ছে তখন ভারত মহাসাগর হয়ে উঠছে জ্বালানি, বাণিজ্য ও ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রস্থল।

দ্রুত বদলে যাচ্ছে বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের খনিজসমৃদ্ধ দেশগুলোর বাজার খুলে দেওয়া হচ্ছে। সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মহাক্ষমতাধর যুক্তরাষ্ট্রকে 'চোখ রাঙাচ্ছে' মহাচীন।

পশ্চিমের দেশগুলো ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরের দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে কৌশলগত পরিবর্তন আনছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও নিজেদের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে নতুন করে সাজিয়ে নিচ্ছে।

পাকিস্তানের উপকূলে তুরস্কের উপস্থিতির ফলে ভারত মহাসাগরে একক দেশ বা শীর্ষ ক্ষমতাধর দেশগুলোর আধিপত্যে নতুন ও মাঝারি শক্তিধর দেশগুলো ভাগ বসাচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।

অনেকে মনে করেন—ভারত মহাসাগরের এই বিশাল জলরাশির বুকে নতুন 'খেলোয়াড়' হিসেবে আঙ্কারার আগমন ‍নিয়ে এই মুহূর্তে হয়ত কোনো দেশ উচ্চবাচ্য করবে না; তবে দক্ষিণ এশিয়ার জলরাশিতে পশ্চিম এশিয়ার এই দেশের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি ভবিষ্যতে অনেকের দৃষ্টি কাড়বে।

ভারত মহাসাগরে পাকিস্তানের সঙ্গে তুরস্কের অংশীদারিত্ব যে জ্বালানি চুক্তির চেয়েও বেশি কিছু তা সংবাদ প্রতিবেদনটিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, ভারত মহাসাগরের কৌশলগত গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে। তাই এই দুই দেশকে হিসাব কষে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে হবে।

পাকিস্তানের জন্য এটা একটা সুযোগ বলে মনে করছে দৈনিকটি। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক অংশীদারিত্বের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সুযোগ পাবে ইসলামাবাদ।

প্রতিবেদন অনুসারে—পাকিস্তানের উপকূলে তুরস্কের তেল-গ্যাস খোঁজার কাজ দিন শেষে ব্যর্থ হলেও এই সংক্রান্ত দুই দেশের চুক্তি ইতোমধ্যে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আলো ফেলেছে। এটি আঙ্কারা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের মুকুটে নতুন পালক যোগ করেছে। এই দেশ দুটি তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল।

তুরস্ক ও পাকিস্তানের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে তা তাদের সাগরনীতি ও জ্বালানি ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যকরণের পাশাপাশি আঞ্চলিক পটপরিবর্তনে অবদান রাখবে বলেও প্রতিবেদনে আশা করা হয়।

এই সুবিশাল জলরাশিতে বিদ্যমান দেশগুলোর প্রভাব ফিকে হয়ে আসছে। সেখানে নতুন নতুন দেশের উপস্থিতি বাড়ছে। আঙ্কারা-ইসলামাবাদের ঘনিষ্ঠতা আগামী দশকে ভারত মহাসাগরের দৃশ্যপট আরও পাল্টে দেবে বলেও আশা করছেন অনেকে। তবে তা ঠিক কতটা পাল্টে দেবে বা কতটা প্রভাব ফেলবে তা ভবিষ্যৎ-ই বলে দেবে।

এ দিকে, দ্য ডিপ্লোম্যাট সাময়িকীর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের সঙ্গে চীন, তুরস্ক ও অন্যান্য দেশের সামরিক অংশীদারিত্ব ভারতের জন্য উদ্বেগের হওয়া উচিত।

তাই আঙ্কারা-ইসলামাবাদের নতুন চুক্তি নয়াদিল্লির জন্য কতটুকু উদ্বেগের হয় তা এখন দেখার বিষয়।

Comments

The Daily Star  | English
Sharif Osman Hadi dies in Singapore

Sharif Osman Hadi no more

Inqilab Moncho spokesperson dies in Singapore hospital

9h ago