কর্মক্ষেত্রে বুলিংয়ের শিকার?

অফিসে বুলিং
ছবি: অর্কিড চাকমা

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অনেকেই মনে করেন বুলিং কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের করিডরেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে ধারণাটি একেবারেই ভুল। প্রাপ্তবয়স্করাও নিজেদের জীবনে নানা সময়ে বুলিং এর শিকার হতে পারেন, অর্থাৎ 'বুলিং' শব্দটি তাদের জীবনেও উপস্থিত এবং এই বুলিং এর পরিণতি তাদের জন্যেও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

ওয়ার্কপ্লেস বুলিং ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুসারে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ কর্মক্ষেত্রে বুলিংয়ের শিকার হন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পরিস্থিতিও বেশ উদ্বেগজনক। এ বিষয়ে সচেতনতা না থাকায়, কর্মক্ষেত্রে অনেকই দিনের পর দিন নীরবে এই কষ্ট সহ্য করে যাচ্ছেন।

একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ বর্ষা জাহান বলেন, 'একটি সূক্ষ্ম খোঁচা দিয়ে শুরু হয়েছিল। শুরুতে আমার টিম ম্যানেজার আমার পোশাক নিয়ে মন্তব্য করতেন। কিন্তু পরে যেকোনো সাধারণ আলাপচারিতার মধ্যেও তিনি আমাকে অপমান করতেন। মূলত আমার সামাজিক-আর্থিক অবস্থার জন্য তিনি আমাকে লক্ষ্যবস্তু বানান, আমি একজন ইন্টার্ন হওয়া সত্ত্বেও শুধুআমার বাবা-মা আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়ার কারণে তিনি আশা করতেন আমি পুরো অফিসকে খাওয়াব।'

একটি খ্যাতনামা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (MFS) প্রতিষ্ঠানের এইচ আর ইন্টার্ন শাবাব জুয়ায়েদ তার অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে বলেন, 'কলেজ শেষ করার পর প্রথম চাকরিতেই আমি কর্মক্ষেত্রে এ ধরনের হয়রানির শিকার হই। দলের সবার থেকে বয়সে ছোট হওয়ায় এক সিনিয়র সহকর্মী সবার সামনে প্রায়ই উপহাসের সুরে আমার কাজের সমালোচনা করতেন। মাঝে মাঝে কিছু সহকর্মীও এতে যোগ দিতেন, সম্ভবত সিনিয়রদের কাছে প্রিয় হওয়ার জন্য।'

যদিও কর্মক্ষেত্রে বুলিং নতুন কিছু নয়, তবে গোপন বা সূক্ষ্ম হয়রানির ঘটনা বেশি দেখা যায়।

তিনি আরো বলেন, 'আমাকে এমন সব কাজ দেওয়া হতো, যা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা অসম্ভব ছিল। এছাড়া আমার কাজের জন্য দরকারি তথ্য দেওয়া হতো না। আমাকে এক প্রকার ইচ্ছা করেই ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা চলত।'

শাবাবের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যোগ করে বর্ষা বললেন, 'জীবনে আমি কখনো এতটা একাকী ও কোণঠাসা অনুভব করিনি। এটি প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল যে, বাকিদের থেকে ভিন্ন মতাদর্শ থাকলেই তাকে কোণঠাসা করে ফেলা হয়। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম যখন দেখেছি একটা অফিস ট্রিপের আগে পর্যন্ত তারা আমাকে তাদের গ্রুপ চ্যাটে অ্যাড করেনি।'

বিশেষ করে নারীদের এ ধরনের বুলিংয়ের শিকার হওয়া বিষয়টিকে আরো জটিল করে ততোলে।

একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক মাইশা রহমান বলেন, 'বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার বিষয়টি অনেক ঠুনকো হয়ে উঠেছে। সমাজ হিসেবে এখনো নেতৃত্বের ভূমিকায় নারীদের সহজভাবে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি। আত্মবিশ্বাসী হওয়া এবং ঔদ্ধত্যের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু নিজের মতামত প্রকাশে আত্মবিশ্বাসী নারীদের অহংকারী আখ্যা পেতে হয় নিজের সহকর্মীদের থেকেই।'

তিনি আরো বলেন, 'আমি যখন জানতে পারলাম আমার সহকর্মীরা আমার পেছনে আমাকে নিয়ে কথা বলেন, আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। আমি কেবল আমার কাজের প্রতি মনোযোগী হয়ে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছিলাম।'

কর্মক্ষেত্রে এ ধরনের বুলিংয়ের পরিণতি অনেক ভয়ানক হতে পারে। ভুক্তভোগীর মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করার পাশাপাশি এটি প্রতিষ্ঠানের কাজকেও বাধাগ্রস্ত করে।

শাবাব জুনায়েদ বলেন, 'বুলিংয়ের শিকার হওয়া আমার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ভয়ানক প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষ করে কাজে যাওয়ার ব্যাপারে আমি ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকতাম। আমার ঘুমের সমস্যা হতো, প্রায়ই বিষণ্ন থাকতাম এবং নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতাম। এগুলো মারাত্মকভাবে আমার কাজের ওপর প্রভাব ফেলত। আমি আমার কাজ দেখানোর সময় উদ্বিগ্ন থাকতাম, নিজেকে বারবার প্রশ্ন করতাম এবং সমালোচনা এড়াতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে সবকিছু নিখুঁত করে করার চেষ্টা করতাম। ক্রমাগত মানসিক চাপে থাকার কারণে আমার কর্মদক্ষতা কমে যায়।'

বর্ষা জাহান বলেন, 'কর্মক্ষেত্রে এই নেতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলো আমার ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব ফেলেছিল। বাড়ি ফিরে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর মানসিক শক্তি থাকত না। সপ্তাহের শেষে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করারও শক্তি পেতাম না।'

বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে কর্মস্থলে হয়রানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট এইচআর প্রোটোকল স্থাপন করা হয়েছে।

একটি বহুমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের এইচ আর এক্সিকিউটিভ রাইসা হক ব্যাখ্যা করে বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য এমন একটি কর্মপরিবেশ তৈরি করা যেন সবাই ন্যায়সঙ্গত আচরণ পান, ভুক্তভোগীরা যেন বিস্তারিত তথ্যসহ লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। পরিস্থিতি ও অভিযোগের গুরুত্ব অনুযায়ী, এইচ আর বিভাগ একটি বিশেষ কমিটির মাধ্যমে তদন্ত শুরু করবে। তদন্তে হয়রানির ঘটনা প্রমাণিত হলে শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে, এমনকি চাকরিচ্যুতি পর্যন্ত ঘটতে পারে। এছাড়া উভয় পক্ষরই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ রয়েছে।'

তবে কর্মক্ষেত্রে বুলিং মোকাবিলায় এই নীতিগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। মাইশা উল্লেখ করেন, 'যথেষ্ট প্রমাণ ছাড়া যেকোন অভিযোগকে সমর্থন করা খুবই চ্যালেঞ্জিং, প্রমাণ ছাড়া তদন্ত শুরু করা যায় না। তাছাড়া, প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ উত্থাপন করলে ভুক্তভোগী ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। তারা শুধুমাত্র সামাজিক বিচ্ছিন্নতার শিকারই নন, বরং নতুন চাকরি খুঁজতেও সমস্যায় পড়তে পারেন, কারণ এইচআর বিভাগ প্রায়ই আগের কর্মক্ষেত্রে যোগাযোগ করে ওই ব্যক্তির বিষয়ে যাচাই করে।'

কর্মক্ষেত্রে বুলিং মোকাবিলার বর্তমান প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে এখনো জটিলতা রয়ে গেছে, তাই সবার জন্য একটি সুন্দর ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে আরও পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

 

Comments

The Daily Star  | English

Jet slams into school, kills 22, mostly children

The final bell had rung.Dozens of children from the primary section of Milestone School and College in Dhaka, along with their guardians and teachers, lingered inside the two-storey building -- some preparing to head home, chatting and winding down from the day.

3h ago