প্রোসপেরা: মৃত্যু আর কর ফাঁকি দিতে ধনকুবেররা ছুটে যান যে দ্বীপে

প্রোসপেরা

ক্যারিবিয়ান অঞ্চল বরাবরই ছুটির গন্তব্য হিসেবে পরিচিত—ফিরোজা সমুদ্র, সাদা বালু আর ঝামেলাহীন সময়। কিন্তু হন্ডুরাসের রোয়াতান নামের এক দ্বীপে গড়ে উঠছে এক ভিন্নধারার স্বর্গ—যেখানে মানুষ শুধু অবকাশ কাটাতে নয়, বরং মৃত্যু, কর আর আমলাতন্ত্রকে ফাঁকি দিতেই ছুটে আসছে।

এই শহরের নাম প্রোসপেরা। এটি একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন, আধা-স্বায়ত্তশাসিত শহর, যেটি গড়ে উঠেছে হন্ডুরাস সরকারের বিশেষ আইনের আওতায়। এর পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আর সিলিকন ভ্যালির ধনীদের টাকাপয়সা। শহরটি মূলত টার্গেট করছে সেইসব ধনী উদ্যোক্তা, বায়োহ্যাকার এবং স্বাধীনতাকামী মানুষদের, যারা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, আইন আর কর থেকে মুক্ত হয়ে নতুনভাবে বাঁচতে চায়।

প্রোসপেরার বাসিন্দারা প্রায় যেন এক 'লিবারটোপিয়া'-য় বাস করছেন। এখানে আয়কর মাত্র ৫%, আর কর্পোরেট কর মাত্র ১%। একটি কোম্পানি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই স্মার্টফোন দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা সম্ভব। এখানকার নিয়ন্ত্রণনীতি ঐচ্ছিক—আপনি চাইলে যেকোনো দেশের আইন অনুসরণ করতে পারেন, এমনকি নিজের আইনের খসড়াও তৈরি করতে পারেন।

এই ধরনের স্বাধীনতার কারণে এখানে এমন সব উদ্যোগের জন্ম হচ্ছে, যেগুলো অন্য কোথাও সম্ভব নয়। বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে। অনুমোদন না পাওয়া নানা পরীক্ষামূলক চিকিৎসা, যেমন দীর্ঘায়ু বৃদ্ধির জিন থেরাপি, এখানে চালু রয়েছে। আর এসবই আকর্ষণ করেছে প্রযুক্তিবিদ ব্রায়ান জনসনের মতো মানুষদের, যিনি বয়সের ঘড়িকে উল্টো দিকে ঘোরাতে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করছেন, ফাঁকি দিতে চাচ্ছেন মৃত্যুকে।

৪৭ বছর বয়সী জনসন গত বছর দুবার রোয়াতানে এসে মিনিসার্কেল নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে থেরাপি নিয়েছেন। এরপর তিনি দাবি করেন, 'আমার শারীরিক বয়স এতটাই ধীর হয়ে গেছে যে এখন থেকে আমি প্রতি ২১ মাসে একবার জন্মদিন পালন করলেই যথেষ্ট।'

প্রোসপেরা প্রকল্পের পেছনে আইনি ভিত্তি তৈরি করে ২০১৩ সালে হন্ডুরাসে পাশ হওয়া শেহ-দেহ বা জেডে (জোনস ফর এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ইকোনোমিক ডেভলপমেন্ট) আইন। এই আইন অনুযায়ী, হন্ডুরাসে স্বায়ত্তশাসিত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা সম্ভব যেখানে করনীতি ও শাসনব্যবস্থা আলাদা। অর্থনীতিবিদ পল রোমার ২০০৯ সালের টেড টকে বলেন, উন্নয়নশীল দেশে এ ধরনের 'চার্টার সিটি' গঠন করলে তা স্বচ্ছ শাসন ও প্রতিযোগিতামূলক বাজারের মাধ্যমে উন্নয়ন ঘটাতে পারে।

তবে এই উদ্যোগ সর্বজনীন প্রশংসা পায়নি। সমালোচকরা বলছেন, এটা এক ধরনের আধুনিক উপনিবেশবাদ। তারা প্রশ্ন তোলেন—এই জায়গাগুলোতে কারা উপকৃত হচ্ছেন? স্থানীয় মানুষ, না ধনী বিদেশিরা? হন্ডুরাসের সরকারের বিশেষ অঞ্চলবিরোধী কমিশনার ফার্নান্দো গার্সিয়া বলেন,'আসল উপকারভোগী কারা? ধনকুবের আর বিলিয়নিয়াররা, যারা আমাদের জাতীয় ভূখণ্ডের স্বর্গসদৃশ অংশে গিয়ে থাকেন এবং পরে আরও জমি কব্জা করে।'

২০২১ সালে হন্ডুরাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সিওমারা কাস্ত্রো। তিনিই জেডে পদ্ধতি পুরোপুরি বাতিলের ঘোষণা দেন। ২০২৩ সালে তিনি আইন করে প্রোসপেরা এবং আরও দুটি অঞ্চলের কার্যক্রম বন্ধ করতে উদ্যোগ নেন। এর জবাবে প্রোসপেরার বিনিয়োগকারীরা, যাদের মধ্যে পেপ্যালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা পিটার থিল-ও আছেন, হন্ডুরাস সরকারের বিরুদ্ধে ১০.৭ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবিতে মামলা করেন। মামলাটি এখন চলছে বিশ্বব্যাংকের ট্রাইবুনালে।

আরেকটি বড় ধাক্কা আসে, যখন জেডে ব্যবস্থার অন্যতম প্রবক্তা ও কাস্ত্রোর পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট জুয়ান অরল্যান্ডো হার্নান্দেজ যুক্তরাষ্ট্রে কোকেইন পাচারের দায়ে ৪৫ বছরের জেল খাটতে শুরু করেন। এতে প্রোসপেরা সম্পর্কে জনমনে আরও সন্দেহ দানা বাঁধে।

প্রসপেরার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ছিল দুবাইয়ের অনুকরণে গড়ে ওঠা এক স্মার্ট সিটি। কিন্তু বাস্তবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় নির্মাণটি হচ্ছে একটি ১৪ তলা বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ভবন—রোয়াতানের সবচেয়ে উঁচু ভবন, যেটি স্থানীয়দের ভাষায় 'ক্রেন ছাড়াই নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে, কারণ এখানে শ্রম খুবই সস্তা।' অন্য প্রস্তাবিত ভবনগুলোর অধিকাংশই এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এখন পর্যন্ত প্রোসপেরার সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে এক পাশের হোটেল ও গলফ রিসোর্ট কেনা।

প্রোসপেরার সীমানায় কোনো আনুষ্ঠানিক দেয়াল নেই, কিন্তু প্রবেশ করতে হলে আগে থেকে নিবন্ধন করতে হয় এবং প্রবেশের সময় একটি কিউআর কোড দেখাতে হয়। নিবন্ধনের মাধ্যমে কেউ সম্পত্তি কিনতে বা ব্যবসা খুলতে পারেন।

এই অঞ্চলের সীমানার বাইরে রয়েছে 'ক্রফিশ রক' নামের একটি জেলে গ্রাম, যেখানে আমগাছের ছায়ায় ইংরেজি বলা মানুষ বসবাস করে। এরা মূলত ব্রিটিশ শাসনামলে আনা আফ্রিকান দাসদের বংশধর।

স্থানীয়দের মধ্যে কেউ কেউ এই উন্নয়নকে সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন। গৃহবধূ সারা স্টুয়ার্ট বলেন, 'আমি এতে ঠিক আছি। হয়তো কোনো একদিন আমি এর ভেতরে ঢুকে একটা চাকরিও পেতে পারি।'

তবে অনেকে ক্ষুব্ধ। একজন স্থানীয় বলেন,'একজন প্রেসিডেন্ট দেশের অংশ বিক্রি করে দিতে পারেন না! এখন তারা ১১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করছে—এটা কে দেবে? আমরা?'

প্রোসপেরার পক্ষে যারা আছেন, তারা বলেন, এ ধরনের শহর দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারব্যবস্থার বাইরে বিকল্প হিসেবে গড়ে ওঠে।

তবে বাস্তবতা বলছে, আইনি লড়াই আর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার কারণে এই ভবিষ্যতমুখী স্বপ্ন এখন মাটিতেই থমকে গেছে।

 

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh airport cargo fire losses

Airport fire may delay RMG, pharma production by at least two months

Local manufacturers are scrambling for raw materials after a massive fire destroyed imported production inputs at the cargo complex of Dhaka airport on Saturday.

10h ago