হ্যালোইনের যত আদি প্রথার নেপথ্যের গল্প
কুমড়ো কেটে মুখ বানানো, মুখোশ পরে বাড়ি বাড়ি ঘোরা আর ভয় ধরানো পোশাক পরার মতো ঐতিহ্যগুলো আজ হ্যালোইনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এই উৎসবের শেকড় অনেক গভীরে—প্রাচীন সেল্টিক ধর্মীয় উৎসব স্যামহেইন-এ (গায়েলিক উচ্চারণ 'সা-উইন')। এটি ছিল গ্রীষ্মের ফসল ঘরে তোলার পর নতুন ঋতুকে স্বাগত জানানোর উৎসব। মানুষ তখন অগ্নিকুণ্ড জ্বালাতো, মুখোশ পরত—অশুভ আত্মাকে তাড়ানোর জন্য।
অষ্টম শতকে পোপ গ্রেগরি তৃতীয় ১ নভেম্বরকে 'সকল সাধুদের দিবস' বা 'অল সেইন্টস ডে' হিসেবে ঘোষণা করেন। ধীরে ধীরে স্যামহেইন-এর অনেক প্রথাই এই খ্রিস্টীয় উৎসবে মিশে যায়। আর সেই অল সেইন্টস ডে-এর আগের সন্ধ্যাকে বলা হতো অল হ্যালোস ইভ—যা পরবর্তী কালে সংক্ষিপ্ত হয়ে হ্যালোইন নামে পরিচিত হয়।
চলুন, দেখে নেওয়া যাক আজকের হ্যালোইনের জনপ্রিয় নানা রীতির পেছনের কাহিনী।
জ্যাক-ও'-ল্যান্টার্ন খোদাই
এই প্রথার উৎপত্তি আয়ারল্যান্ডে। তবে তখন কুমড়ো নয়—শালগম বা বড় মূলজাতীয় সবজিতে মুখ খোদাই করা হতো। এর পেছনে আছে এক কিংবদন্তি—'স্টিনজি জ্যাক' নামের এক প্রতারক লোক নাকি বারবার শয়তানকে ফাঁদে ফেলেছিল এবং প্রতিশ্রুতি নিয়েছিল, সে কখনো নরকে যাবে না। কিন্তু মৃত্যুর পর স্বর্গও তাকে আশ্রয় দেয়নি। অন্ধকারে ঘুরে বেড়ানো আত্মাকে পথ দেখাতে শয়তান তাকে দিলো জ্বলন্ত কয়লার টুকরো—যা সে রাখল একটি খোদাই করা টার্নিপের ভেতরে। স্থানীয় লোকজন পরে নিজেদের টার্নিপে ভয়ংকর মুখ এঁকে খারাপ আত্মাকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে শুরু করল।
আত্মা দেখা
স্যামহেইন উৎসব ছিল ফসল তোলার পরবর্তী বছরের সূচনালগ্ন। সেল্টিকদের বিশ্বাস ছিল, এ সময় মৃতদের আত্মা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়। পরে খ্রিস্টান মিশনারিরা অল সোলস ডে (২ নভেম্বর) প্রবর্তন করেন, যাতে জীবিতদের সঙ্গে মৃতদের যোগাযোগের এই বিশ্বাস টিকে থাকে।
ভয় ধরানো পোশাক
স্যামহেইনের রাতে অশুভ আত্মা যাতে মানুষকে চিনে ভয় না দেখাতে পারে, তাই সেল্টিকরা ছদ্মবেশে বের হতো। ভয়ংকর পোশাক ও মুখোশ পরার এই প্রথা থেকেই জন্ম হ্যালোইনের 'স্ক্যারি কস্টিউম'-এর।
ট্রিক অর ট্রিট
'ট্রিক অর ট্রিট'-এর উৎপত্তি নিয়ে নানা মত আছে। এক মতে, স্যামহেইনের সময় মানুষ আত্মাদের শান্ত করতে বাইরে খাবার রেখে দিত। পরে লোকেরা নিজেরাই আত্মার সাজে ঘরে ঘরে ঘুরে খাবার চাইতে শুরু করে।
অন্য মতে, এটি এসেছে মধ্যযুগীয় স্কটিশ প্রথা গাইজিং থেকে। তখন গরিব মানুষ বা শিশুরা অল সোলস ডে-তে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মৃতদের আত্মার জন্য প্রার্থনা করত, আর তার বিনিময়ে পেত খাবার বা অর্থ। সময়ের সঙ্গে প্রার্থনার বদলে জায়গা নেয় গান, কৌতুক বা ছোট 'ট্রিক'।
তৃতীয় মতে, এই রীতি এসেছে জার্মান-আমেরিকান বড়দিনের উৎসব বেলসনিকলিং থেকে—যেখানে শিশুরা ছদ্মবেশে প্রতিবেশীর বাড়ি যেত, আর কেউ তাদের চেনতে না পারলে পেত খাবার বা উপহার।
কালো বিড়াল
মধ্যযুগ থেকেই কালো বিড়ালকে অশুভ বলে ধরা হতো—শয়তানের প্রতীক হিসেবে। পরে 'ডাইনি' অভিযানের সময় অনেক নারীর ঘরে কালো বিড়াল পাওয়া যেত বলে বিশ্বাস করা হয়, বিড়ালরা নাকি তাদের 'ফ্যামিলিয়ার'—অর্থাৎ জাদুতে সহকারী আত্মা। তখন থেকেই কালো বিড়াল আর ভয়, রহস্য আর হ্যালোইনের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়।
কালো ও কমলা রঙ
হ্যালোইনের এই ঐতিহ্যবাহী রঙ দুটিরও রয়েছে সেল্টিক ব্যাখ্যা—কালো মানে গ্রীষ্মের মৃত্যু, আর কমলা হলো শরতের ফসল আর উর্বরতার প্রতীক।
আপেল ভাসানো খেলা
হ্যালোইন পার্টির চেনা খেলা 'ববিং ফর অ্যাপলস'-এর শেকড় প্রেম আর ভবিষ্যদ্বাণীতে। এটি এসেছে রোমান দেবী পোমোনার উৎসব থেকে—যিনি কৃষি আর প্রাচুর্যের প্রতীক ছিলেন। তরুণ-তরুণীরা পানিতে ভাসানো আপেল মুখ দিয়ে তুলতে পারলে কে কার প্রেমিক হবে, তা নাকি বোঝা যেত! রোমানরা যখন খ্রিস্টপূর্ব ৪৩ সালে ব্রিটেনে আসে, তখন স্যামহেইন আর পোমোনা উৎসব একীভূত হয়ে আজকের হ্যালোইনের রূপ নেয়।
দুষ্টুমি বা প্র্যাঙ্ক
হ্যালোইনের আগের রাতকে বলা হতো ডেভিলস নাইট বা মিসচিফ নাইট—যেখানে দুষ্টুমি, ঠাট্টা আর প্র্যাঙ্ক ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। কেউ বলেন, এই রীতি এসেছে মে-ডে উৎসব থেকে; আবার কেউ বলেন, স্যামহেইন আর অল সোলস ডে-তেও এমন হালকা দুষ্টুমি ছিল। পরে আইরিশ ও স্কটিশ অভিবাসীরা এই প্রথা আমেরিকায় নিয়ে আসে।
আলো ও আগুন
প্রাচীনকালে স্যামহেইনের সময় বিশাল অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হতো—মৃত আত্মাদের পরজগতে পৌঁছাতে সাহায্য করার প্রতীক হিসেবে। আধুনিক হ্যালোইনে সেই আগুনের জায়গা নিয়েছে মোমবাতির নরম আলো।
ক্যান্ডি আপেল
শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষ ফল সংরক্ষণের জন্য তা সিরাপে ডুবিয়ে রাখত। পোমোনা উৎসবে আপেল ছিল দেবীর প্রতীক। ১৯০৮ সালে নিউ জার্সির মিষ্টি প্রস্তুতকারক উইলিয়াম ডব্লিউ কোলব দুর্ঘটনাবশত লাল দারচিনির ক্যান্ডির সিরাপে আপেল ডুবিয়ে তৈরি করেন চকচকে ক্যান্ডি আপেল। ক্রেতারা মিষ্টির বদলে আপেল কিনতে শুরু করে, আর সেগুলো দ্রুত হ্যালোইনের ফ্যাশনেবল উপহার হয়ে ওঠে। ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত ক্যান্ডি আপেল ছিল উৎসবের অপরিহার্য অংশ।
বাদুড়
স্যামহেইনের প্রাচীন অগ্নিকুণ্ডগুলো পোকামাকড় আকর্ষণ করত, আর সেই পোকা খেতে আসত বাদুড়। তাই বাদুড় দেখা উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। পরে মধ্যযুগীয় লোককথা বাদুড়কে মৃত্যু ও অশুভের প্রতীক বানিয়ে দেয়—যা আজও হ্যালোইনের অংশ।
মিষ্টিমুখ করা
হ্যালোইনের শুরুতে শিশুদের 'ট্রিট' হিসেবে ফল, বাদাম, কয়েন বা ছোট খেলনা দেওয়া হতো। ১৯৫০-এর দশকে ছোট প্যাকেটজাত মিষ্টি বাজারে এলে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর ১৯৭০-এর দশকে যখন বাবা-মায়েরা খোলা খাবার নিয়ে শঙ্কিত হতে শুরু করেন, তখন থেকে ক্যান্ডিই হয়ে যায় হ্যালোইনের অপরিহার্য অংশ।
ক্যান্ডি কর্ন
১৮৮০-এর দশকে পেনসিলভানিয়ার ওয়ান্ডারলে ক্যান্ডি কোম্পানি-র এক কারিগর প্রথম তিন রঙা এই মিষ্টি বানান। পরে ১৮৯৮ সালে গোয়েলিটজ কোম্পানি এটি ব্যাপকভাবে বাজারজাত করে। তখন একে বলা হতো 'চিকেন ফিড' আর বাক্সে লেখা থাকত—'Something worth crowing for!' প্রথমে এটি ছিল শরতের ফসল উৎসবের প্রতীক হিসেবে, কিন্তু ১৯৫০-এর দশকে ট্রিক-অর-ট্রিট জনপ্রিয় হলে ক্যান্ডি কর্ন হয়ে ওঠে হ্যালোইনের বিশেষ মিষ্টি।
শেষকথা
হ্যালোইন আজ যতটা ভয় আর আনন্দের মিশেল, তার পেছনে রয়েছে হাজার বছরের সংস্কৃতি, ধর্ম আর লোককথার স্তর। সেল্টিকদের আত্মা-সংক্রান্ত বিশ্বাস থেকে শুরু করে রোমান প্রেমের খেলা, ইউরোপীয় জাদুবিদ্যা—সব মিলে আজকের হ্যালোইন যেন ইতিহাসেরই এক রঙিন মুখোশ পরা উৎসব।


Comments