ভিন্ন ধর্মের ক্ষেত্রে বিয়ের আইন কী, কাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য
ভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে বিয়ে সম্পর্কিত আইন, বিবাহ ও বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া, সীমাবদ্ধতাসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মমতাজ পারভীন মৌ।
ভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে বিয়ের ক্ষেত্রে আইন কী বলে
আইনজীবী মমতাজ পারভীন মৌ বলেন, বিয়ে যতটা আইনগত বিষয়, তারচেয়েও বেশি ধর্মীয়। সাধারণত একই ধর্মের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় আচার, রীতিনীতি বা নিয়ম মেনেই বিয়ে সম্পন্ন হয়। আমাদের দেশে ইউনিফর্মড ফ্যামিলি কোড নেই। প্রত্যেক ধর্মের জন্য আলাদা আলাদা পারিবারিক আইন প্রযোজ্য—যা তাদের নিজস্ব ধর্মের বিধান অনুযায়ী প্রণীত।
কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যখন দুজন ভিন্নধর্মী মানুষ বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন মূল প্রশ্নটা হয় বিয়েটা কোন ধর্মের বিধান অনুযায়ী বা কোন আইন অনুযায়ী হবে। যদি নিজেরা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে কেউ একজন নিজ ধর্ম ত্যাগ করে অপরের ধর্ম গ্রহণ করে নেন, তাহলে সমস্যা থাকে না। কিন্তু যদি দুজনেই নিজ নিজ ধর্মে বহাল থেকে বিয়ে সম্পন্ন করতে চান, সেক্ষেত্রে 'বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২' এর অধীনে বিয়ে সম্পন্ন করতে হয়। এই আইন বাংলাদেশে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের, নাস্তিক বা কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করে না এমন ব্যক্তিদের মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন করার সুযোগ দেয়।
স্বামী-স্ত্রীকে একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে হয় না। অর্থাৎ স্বামী বা স্ত্রীর ধর্মীয় পরিচয় পরিবর্তন না করেই বিবাহ করা সম্ভব হয়। এই আইনের অধীন শুধু দেশের নাগরিকরাই নয়, দেশটিতে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে আন্তঃধর্মীয় বিবাহ সম্পন্ন করা যায়। এমনকি প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকরাও করতে পারবে। তবে সেক্ষেত্রে কোনো এক পক্ষকে নোটিশ দানের কমপক্ষে ১৫ দিন আগে থেকে দেশে অবস্থান করছেন এটা দেখাতে হবে।
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত এক বা একাধিক ম্যারেজ রেজিস্ট্রার এই আইনের অধীনে বিবাহ নিবন্ধন করতে পারেন। তবে বাংলাদেশে একমাত্র পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীতে ওই আইনের অধীন বিবাহ নিবন্ধন হয়।
কোন কোন ধর্মের মানুষ বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিয়ে করতে পারেন
বিশেষ বিবাহ আইন অনুযায়ী, যেকোনো ধর্মের ব্যক্তি (হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারসি ইত্যাদি) বা যারা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের অন্তর্ভুক্ত নন, তারা একে অপরের সঙ্গে বিবাহ করতে পারেন। কিন্তু কোনো মুসলিমের ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ কোনো মুসলিম অন্য কোনো ধর্মে বিশ্বাসী কাউকে বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ে করতে পারবেন না। মুসলিমরা যে অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করতে পারবে না বা বিয়ে করলে সেটা অবৈধ হবে—সে বিষয়টি সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি রায়েও বলা হয়েছে। বিশেষ বিবাহ আইনের বিয়ের বিষয়ে এটি একটি ঐতিহাসিক রায়।
আইনটিতে বিবাহের ব্যাপারে উভয়পক্ষের ক্ষেত্রে বহুগামিতা ও ধর্মান্তর অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকলে অথবা সাধারণ পূর্বপুরুষ বা প্রপিতামহ কিংবা প্রপিতামহের চেয়ে ঘনিষ্ঠ পূর্বপুরুষ থাকলে ওই আইনে নিবন্ধন হবে না।
বিশেষ বিবাহ আইনের অধীনে বিয়ে কীভাবে সম্পন্ন করতে হয়
আইনজীবী মমতাজ পারভীন মৌ বলেন, বিশেষ বিবাহ আইনের অধীনে সম্পন্ন হওয়া একটি বৈধ বিয়ের জন্য মৌলিক প্রয়োজনীয়তা হলো বিয়েতে উভয় পক্ষের সম্মতি। বিবাহের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষই যদি একে অপরকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক হয়, তবে এটাই যথেষ্ট; জাতি, ধর্ম ইত্যাদি এখানে তাদের মিলনে বাধা হিসেবে কাজ করতে পারে না। এই আইনের অধীনে বিবাহের জন্য পক্ষগুলোকে বিবাহ নিবন্ধকের কাছে একে অপরকে বিয়ে করার অভিপ্রায় উল্লেখ করে নোটিশ দাখিল করতে হবে।
বিবাহের পক্ষগুলোর মধ্যে অন্তত একজন এই ধরনের নোটিশের তারিখের কমপক্ষে ১৫ দিন আগে সংশ্লিষ্ট স্থানে বসবাস করেছে বলে নোটিশ দাখিল করা হয়। এই ধরনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হওয়ার তারিখ থেকে ১৫ দিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে বিয়েটি সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু যদি কোনো পক্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো ব্যক্তি এই বিবাহে আপত্তি করেন এবং নিবন্ধক আপত্তির যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখেন, তাহলে এই কারণে তিনি বিবাহ বাতিল করতে পারেন। এ ধরনের বিশেষ বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে রেজিস্ট্রার এবং ঘোষণাপত্রে সই করা তিনজন সাক্ষীর সামনে। বিশেষ বিবাহ আইনের অধীনে বৈধ বিবাহের জন্য এগুলো প্রাথমিক ও প্রধান শর্ত। সেই সঙ্গে সই দেওয়ার পর ওই হলফনামা নোটারি পাবলিক কর্তৃক 'নোটারাইজড' করতে হবে।
সরকারিভাবে এমন বিয়ে হওয়ার একমাত্র স্থান পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলী। তবে অনেকেই নিবন্ধনকারীর বিষয় বা আইনকানুন বা বিয়ের নিয়ম-কারণ সম্পর্কে জানেন না। যারা জানেন না, তারা প্রথমেই কোর্টে যান, আইনজীবীর সহায়তা নেন।
যদি কোর্টে গিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে বিয়ে করেন, সেক্ষেত্রে একজন প্রকৃত আইনজীবীর তত্ত্বাবধানে প্রস্তুতকৃত হলফনামায় পাত্র-পাত্রীকে সই দিতে হবে। এরপর সেই হলফনামা নোটারি পাবলিক কর্তৃক নোটারাইজড করতে হবে।
নোটারি সম্পন্ন করার পর সরকার কর্তৃক অনুমোদিত বিশেষ বিবাহ রেজিস্ট্রারের কাছে নির্ধারিত ফরম পূরণপূর্বক তিনজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হবে। মোট কথা এ ধরনের বিয়ে বিশেষ বিবাহ নিবন্ধকের কাছে নির্ধারিত ফরমে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক।
এ ধরনের বিশেষ বিয়েতে অবশ্যই দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের একটি ফটোকপি প্রয়োজন হয়। স্বামী-স্ত্রী দুইজনেরই লাগবে। যারা এ রকম বিশেষ বিয়ে করার পরিকল্পনা করছেন, তারা অবশ্যই এই দুটি জিনিস আর বিয়ের জন্য তিনজন সাক্ষী নিতেই হবে।
বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ে করার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় শর্ত বা সীমাবদ্ধতা
যেকোনো ধর্মের লোকই 'বিশেষ বিবাহ আইন ১৮৭২' অনুযায়ী তার থেকে ভিন্ন যেকোনো ধর্মের লোককে বিশেষ বিবাহ করতে পারবেন। তবে চাইলেই এ বিয়ে সবাই করতে পারবেন না, মানতে হবে কিছু শর্ত—
১. এ আইনে বিয়ের সময় বিয়ের উভয় পক্ষের মধ্যে কারোরই কোনো জীবিত স্বামী বা স্ত্রী থাকতে পারবে না।
২. কোনো পক্ষ মুসলিম হতে পারবে না।
৩. বিয়ে করতে ইচ্ছুক পুরুষ ব্যক্তির বয়স গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২১ বছর এবং নারীর বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হতে হবে (বিশেষ বিবাহ আইনে বলা আছে, এই আইন অনুযায়ী বিয়ে করতে হলে পুরুষের ১৮ বছর আর নারীর ১৪ বছর বয়স হতে হয়। কিন্তু বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুযায়ী পুরুষ ২১ বছরের নিচে আর নারী ১৮ বছরের নিচে বিয়ে করলে তা বাল্যবিবাহ বলে গণ্য হবে এবং ওই আইনানুসারে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই যে আইনের অধীনেই বিয়ে হোক না কেন, বাংলাদেশে বিয়ের ক্ষেত্রে পুরুষের ২১ আর নারীর জন্য ১৮ বছর নির্ধারিত)।
তবে বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ের ক্ষেত্রে প্রত্যেক পক্ষের বা কোনো এক পক্ষের বয়স ২১ বছর পূর্ণ না হয়ে থাকে, তাহলে বিয়ের জন্য তার পিতা বা অভিভাবকের সম্মতি গ্রহণ করতে হবে।
৪. পক্ষগণ রক্ত সম্পর্কে বা বৈবাহিক সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত হতে পারবেন না।
৫. তিনজন সাক্ষী থাকতে হবে। রেজিস্ট্রার ও সাক্ষীর সামনেই রেজিস্ট্রেশন ফরমে ও শপথ নামায় সই করতে হবে।
৬. বিশেষ বিবাহ আইনের ২২ ধারার বিধান মতে, সহ-উত্তরাধিকারিত্বের ওপর কতিপয় বিয়ের ফলাফল হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্মাবলম্বী কোনো যৌথ পরিবারের কোনো সদস্যের এ আইন মোতাবেক বিয়ে হলে অনুরূপ পরিবার থেকে তার বন্ধন ছিন্ন হয়েছে বলে গণ্য হবে।
৭. বাংলাদেশের কোনো মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, পারসি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন নন বা তাদের একজন যেকোনো একটি বা অন্য ধর্মে বিশ্বাসী তাদের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করতে হলে বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন উপযুক্ত বিবাহের ক্ষেত্রে ধর্ম ত্যাগ করা অত্যাবশ্যক। দুই পক্ষই ধর্ম ত্যাগ না করলে বিয়েটি বাতিল বলে গণ্য হবে। তবে ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রে মুসলিম কোনো ব্যক্তি ইচ্ছা করলে অন্য ধর্মের কোনো ব্যক্তিকে মুসলিম আইন অনুযায়ীই বিয়ে করতে পারেন।
৮. এ আইনের বিধানে যেকোনো ধরনের মিথ্যা বর্ণনা দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আবেদনকারী যদি বাস্তবে ধর্ম ত্যাগ না করে থাকেন, সেক্ষেত্রে ধরা হবে যে, তিনি মিথ্যা বর্ণনা দিয়েছেন।
বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন সম্পন্ন বিয়ের ক্ষেত্রে ডিভোর্সের নিয়ম
বিশেষ বিবাহ আইনের আইনের অধীনে বিবাহিত দম্পতিরা ১৮৬৯ সালের ডিভোর্স অ্যাক্ট অনুযায়ী বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন। এই আইনের অধীনে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে চাইলে একটি নির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট জেলা আদালতে আবেদন করতে হয় এবং আদালতের অনুমতির প্রয়োজন হয়।
আবেদনকারীকে আদালতের কাছে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ জানাতে হবে এবং আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনার পর আদালতের কাছে আবেদনে উল্লেখিত কারণটি সত্য বলে বিবেচিত হলে আদালত ডিভোর্সের ডিক্রি জারি করবেন।
এই আইনের অধীনে যেসব কারণে বিবাহবিচ্ছেদ হতে পারে তার মধ্য অন্যতম হলো—ব্যভিচার, নিষ্ঠুরতা বা বিয়ের অন্য কোনো শর্ত ভঙ্গ। পারস্পরিক সম্মতিতেও বিবাহ বিচ্ছেদ হতে পারে। এক্ষেত্রে, উভয়ে মিলে আদালতে যৌথভাবে আবেদন করতে পারে। আদালত উভয়পক্ষের আবেদন গ্রহণ করে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পর বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রি জারি করবেন।
উত্তরাধিকার বণ্টন কীভাবে হবে
বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিয়ে করা দম্পতির সন্তানরা বৈধ বলে বিবেচিত হবেন। এসব সন্তানরা তাদের বাবা-মায়ের ক্রয় বা অন্য সূত্রে অর্জিত ও উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবেন। কিন্তু তাদের মাতা-পিতা উভয়দিকের পূর্ব পুরুষের সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবেন না। স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হবেন। এক্ষেত্রে উত্তরাধিকার আইন, ১৯২৫ প্রযোজ্য।
উল্লেখ্য, যেকোনো হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্মাবলম্বী ওই আইনে বিবাহের মাধ্যমে তার অবিভক্ত পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছেদ নিশ্চিত করবেন। তবে তিনি উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন না।


Comments