জাপানি কৌশল কিনসুগি: ভাঙা জিনিসের নতুন রূপ

কিনসুগি
ছবি: সংগৃহীত

শখের জিনিস ভেঙে গেলে আঁধার নামে মনের করিডোরে। কারণ ভাঙা জিনিস যতই জোড়া দেওয়া হোক না কেন, তা আর আগের মতো হয় না কখনো। ভাঙার দাগ রয়েই যায়। কিন্তু জাপানি কৌশল 'কিনসুগি' বলে তার উল্টোটা। দাগ থেকে যদি দারুণ কিছু তবে দাগই ভালো এই কথা শুনেছেন নিশ্চয়ই? অনেকটা সেটাই বলে কিনসুগির জাদুর ছটা।

যদি আপনার পছন্দের কোনো শোপিস বা উপহার হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায় কী করবেন? বাতিলের খাতায় ফেলে দেবেন হয়তো। কিন্তু কিনসুগির কায়দা জানা থাকলে ভাঙা জিনিসকে ফিরে পেতে পারবেন নতুন রূপে। এ জন্য জাপানি শব্দ কিনসুগিকে বাংলায় 'সোনার জুড়ি' ও বলা হয়। সোনা, রূপা বা প্লাটিনামের সঙ্গে বার্নিশ মিশিয়ে ভাঙা জিনিসকে জোড়া দেওয়া হয় এতে। ভাঙা দাগকে লুকোনোর বদলে সেটিকেই ফুটিয়ে তোলা হয় এই শিল্পের মাধ্যমে।

কীভাবে এলো কিনসুগি?

কিনসুগির আবির্ভাব নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানা যায়নি। তবে ইতিহাসবিদরা ১৩৩৬ থেকে ১৫৭৬ কমন এরা, যাকে বলে মুরোমাচির সময়কাল, তখন থেকে কিনসুগির আদিকাল মনে করেন। ষোড়শ শতাব্দীতে এটির ব্যবহার বেড়ে যায়। তখন জাপানি টি সেরিমনিও জনপ্রিয় হতে থাকে। চা পরিবেশনের এই আয়োজনে সিরামিকের চায়ের বাটি আভিজাত্যের প্রতীক বহন করে। যাকে চাওয়ান নামেও অভিহিত করা হয়। এই নিয়ে গল্পও আছে জাপানিদের ঘিরে।

১৫ শতকের এক জাপানি সামরিক শাসক আশিকাগা ইয়োশিমাসা একটি চাওয়ান এনেছিলেন চীন থেকে। একদিন সেই বাটি গিয়েছিল ভেঙে। সেটি ঠিক করতে তিনি আবার পাঠিয়েছিলেন চীনে। কিন্তু যখন চায়ের বাটি ফেরত এলো তার কাছে, সেটির সুরত দেখে তার মন গেল বিষণ্ণতায় ঢেকে। জোড়া দেওয়া চায়ের বাটি তার ঘুম যে নিল কেড়ে। তারপর আবার এলাকার এক কারিগরের কাছে নিয়ে গেলেন তিনি। কোনো উপায়ে আগের মতো বাটির রূপ ফিরে পাওয়া যায় কি না ভেবে নাজেহাল তিনি। হঠাৎই তার মনে হলো, ভাঙা টুকরোগুলোকে চকচকে কিছু দিয়ে জোড়া দিলেই তো সেই চিন্তা দূর হয়। সেই থেকে কিনসুগি সাড়া ফেলেছে দিকে দিকে।

কী ব্যবহার করা হয়?

এই জাপানি শিল্পের কদর চারদিকে এত সাড়া ফেলেছে যে লোকজন সিরামিকের জিনিস ইচ্ছে করে ভেঙে তা নতুন মোড়কে সাজাতে শুরু করেছে। আপনার চোখেও পড়েছে হয়তো সেই জিনিসপত্র। এই ভাঙা-গড়ার খেলায় কিছু উপাদান ও কৌশল আয়ত্ত হলেই চলে।

শুরুর দিকে উরুশি নামক গাছের রসের বার্নিশ, চালের গুঁড়ো, গমের আটার মিশ্রণ করা হতো আগে। তারপর ভাঙা টুকরোগুলো ঘষে সেই তৈরিকৃত মিশ্রণ দিয়ে জোড়া লাগিয়ে কাঠের ক্যাবিনেটে রাখা হতো। কয়েক সপ্তাহ উষ্ণ তাপমাত্রায় রাখার পর সেটি বের করে ধারালো কিছু দিয়ে আঠা ছেঁচে ফেলা হতো। তারপর আঠার সঙ্গে সোনার গুঁড়ো ছড়িয়ে দেওয়া হতো। 

আজকাল সিনথেটিক আঠা দিয়ে সহজেই এই কাজ করা যায় আর সোনালিরঙা পাউডার দিয়ে ঢেকে দিলেই সোনার মতো আভা ছড়ায়। তবে উরুশি দিয়ে জোড়া দেওয়া জিনিস আগের মতো ব্যবহার করা গেলেও সিনথেটিক আঠা দিয়ে তা করা যায় না। এটি শুধু সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য, খাবার বা পানীয় পরিবেশনের জন্য নয়। তাই প্রতিদিনকার জিনিসপত্রে কিনসুগি করলে সেগুলো সাজিয়ে রাখাই শ্রেয়।

কীভাবে করবেন?

এই কৌশল ব্যবহার করে ভাঙা জিনিস যেমন গড়া যায়, তেমনি দুটি ভাঙা জিনিস একত্রে করে নতুন কিছু বানানো যায়।

কিনসুগির জন্য ভাঙা টুকরো, কাঠি স্টিক, স্ক্র‍্যাপ পেপার, দুই প্রকারের ইপোক্সি, সোনালি রঙের মাইকা পাউডার জোগাড় করতে হবে।

টুকরো জোড়া দেওয়ার আগে সেগুলো বসিয়ে দেখতে হবে সব অংশ আছে কি না। যদি না থাকে তাহলে আঠা ও মাইকা পাউডার দিয়ে সেরকম অংশ বানিয়ে নিতে হবে। আগে অভিজ্ঞতা থাকলে সহজে করা যাবে। তারপর ভাঙা টুকরোগুলোর চারপাশ হালকা ঘষে নিতে হবে। টুকরোগুলো অবশ্যই যেন শুকনো থাকে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। অনেকগুলো টুকরো হলে বড় টুকরোর সঙ্গে একেক করে জোড়া দেওয়ার জন্য সাজিয়ে নিতে হবে। ইপোক্সির সঙ্গে একটু মাইকা পাউডার মিশিয়ে স্টিকে লাগিয়ে নিতে হবে। তারপর স্টিক দিয়ে একটু করে দুটি ভাঙা টুকরোর সঙ্গে আটকে দিতে হবে। হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ধরে রাখতে হবে। শুকিয়ে গেলে বাড়তি আঠা সাবধানে উঠিয়ে ফেলতে হবে। আঠা অল্প করে না নিলে অসুবিধা হতে পারে। টুকরোগুলো কয়েক ঘন্টা শুকানোর জন্য সময় দিতে হবে। কিনসুগি করাটা সহজ মনে হলেও শুরুর দিকে কষ্টসাধ্য হতে পারে। জিনিস ভালোভাবে জোড়া নাও লাগতে পারে। তবে, অনুশীলন করতে থাকলে সুফল আসবেই।

 

Comments

The Daily Star  | English
child victims of July uprising Bangladesh

Child victims of July uprising: Of abandoned toys and unlived tomorrows

They were readers of fairy tales, keepers of marbles, chasers of kites across twilight skies. Some still asked to sleep in their mother’s arms. Others, on the cusp of adolescence, had just begun to dream in the language of futures -- of stethoscopes, classrooms, galaxies. They were children, dreamers of careers, cartoons, and cricket.

11h ago