প্রবাসী সন্তানের মা: যাদের দিন কাটে টুকরো ভালোবাসা জমিয়ে

প্রবাসীর মা
প্রতীকী ছবি: এআই জেনারেটেড

চমন আরা হোসেনের বয়স এখন ৬৫ বছর। সারাজীবন কাটিয়েছেন গৃহিণী হিসেবে সংসার আর দুই সন্তানকে বড় করার কাজে। সময়ের সঙ্গে তার কাজের ধরন বদলেছে, তবে সব কাজই তার দুই মেয়ে আর নাতি-নাতনিকেন্দ্রীক।

ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই। চমন আরার বাসার ডিপ ফ্রিজ বা ফ্রিজার ঘাঁটলে আপনি পাবেন জিপলক ব্যাগে ভরা কাঁঠালের বিচি, ডালের বড়ি, নলেন গুড়, কচুর লতি, আমসত্ত্ব কিংবা কোড়ানো নারকেল। আরেকটু খুঁজলে ছোট ছোট বক্সে পাওয়া যাবে কোরবানির গরুর মাংস, গরুর ভুড়ি ভুনা, কাবাবের মতো খাবারও।

আর এসবই তিনি একটু একটু করে জমিয়ে রেখেছেন তার ছোট মেয়ে সাবেক সংবাদ পাঠক শেখ ফাতেমা ওয়ারার জন্য। কখন তিনি স্বামী-সন্তান নিয়ে দেশে আসবে আর চমন আরা মেয়ের পছন্দের খাবারগুলো তার পাতে তুলে দেবেন। এমন না যে এসব খাবার ইংল্যান্ডে পাওয়া যায় না, কিন্তু তবু মায়ের মন মানে না। তিনি তার সেরা সংগ্রহটুকু জমিয়ে রাখতে চান মেয়ের জন্য।

শেখ ফাতেমা ওয়ারা গরম গরম পায়েস খেতে পছন্দ করতেন, সে কারণে এখনও বাসায় কখনও পায়েস রান্না হলে মেয়ের কথা মনে করে চোখের পানি ফেলেন চমন আরা।

আমাদের দেশে এরকম অসংখ্য মা আছেন, যাদের সন্তানেরা জীবিকা কিংবা লেখাপড়ার প্রয়োজনে দেশের বাইরে থাকেন। এমন নয় যে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে, তারা হয়তো সুখে-শান্তিতে সংসার করছেন, মন দিয়ে পড়ছেন, ইউরোপ-আমেরিকায় নিজেদের পসার করেছেন দারুণভাবে। কিন্তু তারপরেও দূরদেশে বসে তাদের মায়েরা ছোট ছোট মুহূর্তে সন্তানকে মনে করেন।

ছেলে ভালোবাসেন বলে কোনো মা হয়তো ঘি দিয়ে আলুভর্তা করাই বাদ দিয়েছেন, কেউ বা মেয়ের পছন্দের শুঁটকি ভর্তা আর মুখে তুলতে পারেন না। এমন মায়ের কথাও জানি যিনি ছেলে দেশে না এলে গরুর মাংস খান না, কেউ আবার প্রতিবার শিমের বিচির তরকারি খেতে গিয়ে কান্নাকাটি করেন।

এই মায়েরা সাধারণ জীবনযাপন করেন, রোজ ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত সংসারের হাজারো দায়িত্ব সামাল দেন। সংসারের খুঁটিনাটি থাকে তাদের নখদর্পণে। কোন বাথরুমের কল থেকে পানি পড়ে, কোন মশলা বাটাতে হবে, কোন মাছ কোটাতে হবে, নাতির স্কুল খোলা নাকি বন্ধ, স্বামীর ওষুধ কখন কোনটা খেতে হবে; সব তাদের মুখস্ত। সব কাজ নিপুণভাবে রোজ করে যান তারা। কেবল প্রবাসী সন্তানের পছন্দের খাবার মুখে দিতে গেলে বের হয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস, যা তারা গোপনও করেন সযত্নে।

সংসারের নিত্য কাজের মধ্যেও তাদের মন পড়ে থাকে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে। যেখানে বাস করে তাদের হৃদয়ের একটি অংশ। টাইমজোনের বিপরীত অংশে যে সন্তানেরা বাস করেন তাদের মায়েরা সকাল থেকে ঘড়ি দেখতে শুরু করেন। কখন প্রবাসে সকাল হবে, কখন কয়েক মিনিটের জন্য দেখতে পারবেন সন্তানের মুখ।

সেই প্রবাসী সন্তান কয়টায় ঘুম থেকে ওঠেন, কখন নিজের ছেলে-মেয়েকে স্কুলে দিতে যান, কখন অফিসের জন্য বের হন, কখন ক্লাসের জন্য ট্রেন ধরতে হয়; সব রুটিন দেশে বাস করা মায়েদের মুখস্ত থাকে। প্রতিবার ফোন রাখার আগে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করার কথা বলতে তারা ভোলেন না। তেমনই ভোলেন না নিজের রোজকার প্রার্থনায় সন্তানের মঙ্গল কামনা করতে।

সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ফাতেমা আফরোজের ছোট মেয়ে মারজিয়া বিনতে নিজাম পিএইচডি করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বছরে একবার দেশে আসতে চেষ্টা করেন তিনি। আর মারজিয়া দেশে আসার আগে ফাতেমা আফরোজের ফ্রিজে জমতে থাকে তার পছন্দের নানা খাবার। যার মধ্যে রয়েছে চিংড়ি, দেশি মুরগি থেকে শুরু করে চিজ বল, স্প্রিং রোলের মতো ফ্রোজেন খাবারও। শুধু কি দেশে বসে খাওয়ানো! মেয়ে যেন কিছু খাবার সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে সেটাও নিশ্চিত করেন তিনি।

মজার তথ্য জানালেন মারজিয়ার বড় বোন হোমায়রা ফাতেমা নিজাম।

তিনি বলেন, 'মারজিয়া যাওয়ার পর থেকে আমাদের বাসায় আর বেগুনি বানান না আম্মু। কারণ, বেগুনি মারজিয়ার প্রিয় খাবার। আমাদের সন্ধ্যার চায়ের আসরটাও আর আগের মতো নেই।'

আমেরিকায় তো সবই পাওয়া যায়, মেয়ে নিজেও রান্না করে খেতে পারেন। তাহলে কেন এত খাবার জমান?

এই প্রশ্ন করেছিলাম ফাতেমা আফরোজকে।

জবাবে তিনি বললেন, 'আসলে ওর প্রিয় খাবারগুলো রেখে দিই। ফিরে যাবার সময়ও কিছু খাবার দিয়ে দিই। মনে করি এতে ওর কিছুটা হেল্প হবে। ওখানে তো অনেক ব্যস্ত জীবন। যদি ফ্রিজে দেশের কোনো খাবার রেডি থাকে তাহলে নিশ্চয়ই ও কিছু না খেয়ে বা হাবিজাবি ফ্রোজেন ফুড খেয়ে বের হয়ে যাবে না।'

'তবে একটা লুক্কায়িত বিষয় হলো, মেয়ে বিদেশে বসে আমার দেওয়া খাবার খাবে, আমাকে মনে করবে এটা ভাবতে ভালো লাগে। শান্তি পাই মনে।'

মারজিয়া বিদেশে যাওয়ার পর কোনো রমজানে বাসায় বেগুনি বানাননি বলেও জানান ফাতেমা আফরোজ।

তিনি বলেন, 'আমি বেগুনি খেতে পারি না। কান্না আসে। ও যখন আসে ওকে ভেজে দিই। তখন সবাই মিলে খাই।'

কথা বলেছিলাম মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী সন্তানের মা রত্না বেগমের সঙ্গে। রোজ সন্তানের সঙ্গে হয়তো কথা বলার সুযোগ হয় না, তিনি কবে দেশে আসবেন তাও এখনও জানেন না। তবু এ বছর তার জন্য আমের আচার দিয়েছেন।

রত্না বেগম বলেন, 'ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই আচার ছাড়া ভাত খেতে পারে না। তাই সারাবছর ধরে বিভিন্ন ফলের আচার বানাই। ছেলে দেশে আসলে একবারে অনেক করে নিয়ে যায়, আর যখন আসতে পারে না তখন আমি সারাবছর এগুলো রোদে দিয়ে দিয়ে ভালো রাখি।'

তিনি আচার পছন্দ করেন কি না জানতে চাইলে রত্না বলেন, 'আগে তো খুব খেতাম। এখন খেতে বসলে ছেলেটার কথা মনে হয়, আর খেতে পারি না। তার ওর জন্যই বানাই, ওর জন্যই জমাই।'

এবার মা দিবসেও এই সন্তানেরা মাকে টেলিফোন করে শুভেচ্ছা জানাবেন, কেউ কেউ হয়তো উপহার পাঠাবেন। প্রবাসী মেয়েরা তার নিজের সন্তানের স্কুলে কীভাবে মা দিবস উদযাপন করেছে সেই গল্প মাকে শোনাবেন ভিডিও কলে। আর দেশে বসে আমাদের এই মায়েরা নিজের সন্তানকে একটু ছুঁয়ে দেখার আকুতি নিয়ে আরও একটি বছর পার করে ফেলবেন।

মা দিবস হোক আর সাধারণ দিন হোক, এই মায়েদের দিন শুরু হবে প্রবাসী সন্তানকে মনে করে, তার জন্য ছোট্ট বক্সে প্রিয় খাবারটা তুলে রেখে আর তার প্রিয় খাবারটা মুখে তোলার সময় দীর্ঘশ্বাস গোপন করার মধ্য দিয়ে। প্রতিদিনের মতো তারা জমিয়ে যাবেন তাদের ভালোবাসা, মায়া আর স্নেহ। যা আমরা খুঁজে পাবো ফ্রিজের কোনায় কিংবা ছাদে রোদ পোহানো আচারের বয়ামের ভেতর।

 

Comments

The Daily Star  | English

Victory day today: A nation born out of blood and grit

The tide of war had turned by mid-December in 1971. The promise of freedom was no longer a dream. It had hardened into tangible certainty.

7h ago