কেমন আছে বিউটি বোর্ডিং

ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

`আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি/ এমন ছিলো না আষাঢ় শেষের বেলা/ উদ্যানে ছিল বরষাপীড়িত ফুল, আনন্দভৈরবী।'

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই কবিতাটি মনে পড়ে গেল বিউটি বোর্ডিংয়ে ঢুকতে গিয়ে। পুরান ঢাকার বইপাড়া হিসেবে খ্যাত বাংলাবাজার ঢুকে একটু সামনেই শ্রীশদাস লেন। আর সেখানে অবস্থান বিউটি বোর্ডিংয়ের। বাংলাবাজারে স্থানীয় কাউকে জিজ্ঞাসা করেও জেনে নেওয়া যায় ঠিকানা।

গত শতকের ৫০-৬০ এর দশকে শিল্প-সাহিত্য জগতের মানুষদের বিশাল এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল বিউটি বোর্ডিং। শুরুটা ৫০ এর দশকে। দুই ভাই নলিনী মোহন সাহা ও প্রহ্লাদ সাহা মিলে তৈরি করেন বিউটি বোর্ডিং। বিউটি নলিনী বাবুর মেয়ের নাম।

থাকার জন্য ২৫টি ঘর আর দুপুর, বিকেল ও রাতের খাবারের বন্দোবস্ত নিয়ে শুরু হয় এর পথচলা। কাছেই থাকতেন কবি শহীদ কাদরী। তিনি ডেকে আনেন কবি বন্ধুদের। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, ফজল শাহাবুদ্দীন, সিকদার আমিনুল হক, বেলাল চৌধুরী, রফিকুন নবীসহ বহু কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীর পদার্পণ ঘটেছে এখানে।

সে সময় বইয়ের জগতটা ছিল বাংলাবাজারেই। শহরও ছিল এদিকেই। গুলিস্তান, ওয়ারী, শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার আর পুরান ঢাকার এলাকাগুলো নিয়েই ছিল শহর।

বাংলাবাজারের একদম কাছে হওয়ায় শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয় বিউটি বোর্ডিং। নলিনী বাবুর অবশ্য তেমন পছন্দ ছিল না এই আড্ডা, তবে প্রহ্লাদ বাবুর সমর্থন ছিল আড্ডার প্রতি। ফলে বিউটি বোর্ডিং প্রতিদিন মুখরিত হতো কবি সাহিত্যিকদের পদচারণায়।

প্রতিষ্ঠাতা প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

সে সময় থেকেই তাদের সরিষা ইলিশ, বেগুন ভাজির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ঢাকায়। তবে খাবারের চেয়েও বড় ব্যাপার ছিল আড্ডাটাই। কোলাহল মুখরিত এই জায়গাটিতেই একদিন নেমে আসে ঘাতকের নির্মম থাবা।

১৯৭১ এর ২৮ মার্চ। প্রহ্লাদ সাহা সেদিন শেষবারের মতো এসেছিলেন এখানে। ইমরুল চৌধুরীর সম্পাদিত 'পূর্ণিমার মধ্য বয়সে বিউটি বোর্ডিং' গ্রন্থে তার স্ত্রী প্রতিভা সাহার করা স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ২৫ মার্চ রাতে ঘরে ঢুকে প্রহ্লাদ বাবু বলেন, 'শহরের অবস্থা খুব খারাপ। রাস্তায় পাকিস্তানি আর্মি নেমেছে। পথে আমাকে চেক করেছে।'

২৬ মার্চ তিনি ঘরে ফিরে আবার বলেন, 'ঢাকায় থাকা নিরাপদ নয়, আমাদের দূরবর্তী কোথাও আশ্রয় নিতে হবে।'

২৭ মার্চ সব তালাবদ্ধ করে তারা চলে যান ঋষিকেশ দাস রোডে প্রতিভা সাহার ভাইয়ের বাসায়। ২৮ মার্চ সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল হয়। বোর্ডিংয়ের স্টাফদের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে বোর্ডিং বন্ধ করতে যান প্রহ্লাদ বাবু। সেই যে গেলেন, আর ফিরে এলেন না।

সেদিন বিউটি বোর্ডিংয়ে প্রহ্লাদ সাহাসহ শহীদ হন মোট ১৮ জন। প্রতিভা সাহা তখন সন্তানসম্ভবা। দুই ছেলে সমর ও তারক যথাক্রমে ১০ ও ৭ বছরের। এরপর ২৭-২৮ দিন পথে পথে ঘুরে আগরতলা পৌঁছান তারা। তারপর একসময় স্বাধীন হলো দেশ। দেশে ফিরে প্রায় শূন্য থেকেই শুরু হলো সব। প্রতিভা সাহা বিউটি বোর্ডিংয়ের দায়িত্ব নিলেন। তার ভাসুর নলিনী মোহন বাবু আগেই কলকাতায় স্থায়ী হয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশে এসে নানা জায়গা থেকে অর্থের ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধু ৫ হাজার টাকা ও একটি সার্টিফিকেট দেন। বোর্ডিংয়ের পুরোনো এক ম্যানেজারকে ঠিক করেন নলিনী বাবু।

সমর সাহা (বামে) ও প্রয়াত তারক সাহা। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

বিক্রমপুরে বিমল নামে তাদের এক বেয়ারা থাকতেন। নলিনী বাবু তাকে বলে যান, 'তোকে বাড়িতে দিয়ে গেলাম, তুই ছোট বউ ও তার পরিবারকে দেখবি। আবার বোর্ডিংয়ের দিকেও খেয়াল রাখবি।'

বাংলাবাজারকেন্দ্রিক সাহিত্য আড্ডা আবারও শুরু হলো। বিউটি বোর্ডিং প্রাণ ফিরে পেল। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে বোর্ডিং দেখভাল করতে শুরু করেন তারক সাহা। ১৯৯৫ সাল থেকে আবারও সাপ্তাহিক আড্ডা আয়োজন ও এর সঙ্গে গুণীজন সম্মাননা দিতে শুরু করেন। প্রতি বছর জানুয়ারিতে শুরু হয় পুনর্মিলনী। স্মৃতি রোমন্থনে আসতে থাকেন অনেকেই।

২০১৯ সালে স্ট্রোক করে মারা যান তারক সাহা। এরপর থেকে বোর্ডিংয়ের দেখভাল করছেন তার দাদা সমর সাহা।

সমর সাহা বললেন, 'বোর্ডিং হওয়ার আগে এই বাড়িতে ছিল সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস। গত শতকের চল্লিশ দশকে এখানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এসেছিলেন বলে শুনেছি। সোনার বাংলা পত্রিকাতে শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা বেরিয়েছিল। সৈয়দ শামসুল হকের জন্য এখানে আলাদা একটা লেখার টেবিলই ছিল। তিনি ওতে বসে নিয়মিত লিখতেন।'

ইমরুল চৌধুরীর সম্পাদিত সেই গ্রন্থে বিউটি বোর্ডিং নিয়ে লিখেছিলেন সৈয়দ শামসুল হকও। তার লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৪৯ সালে প্রথম এ বাড়িতে থাকা সোনার বাংলা পত্রিকার অফিসে এসেছিলেন তিনি। তখন তার কবিতা ছাপা হয়নি। পরে বোর্ডিং চালু হলে ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত প্রায় সব লেখাই লিখেছেন এখানে বসে।

সমর সাহা স্মৃতিচারণ করেন শৈশবের। বলেন, 'আমার একদম ছোটবেলায়, স্বাধীনতার আগে শেখ সাহেবকে (বঙ্গবন্ধু) এখানে দেখেছি। সুভাষ দত্তের সুতরাং সিনেমায় অভিনয় করতে চট্টগ্রাম থেকে কবরী এলেন। তিনি উঠেছিলেন এখানে। রাজ্জাক, ফারুকও এসেছেন।'

সমর সাহা বলেন, 'ছোট ভাই তারক সাহার মৃত্যুর পর আমি দেখভাল করছি। ও উদ্যোগ নিয়ে আগের অনেককে, তাদের আড্ডাকে ফিরিয়েছিল। ইমরুল চৌধুরী বিউটি বোর্ডিং সুধী সংঘ তৈরি করলেন। সুধী সংঘের কাজ বছর তিনেক হয় বন্ধ আছে। রোজ সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে বিউটি বোর্ডিং।'

সমর সাহা জানান, 'বাজার প্রতিদিন করি। রান্না দিনে দুবেলা হয়। সকালের পর রান্না করে আনা হয় দুপুরের খাবার। বিকেলে লুচি, আলুর দম। রাতে খুব অল্প লোক খায়। সেজন্য বিকেলে আবার রান্না করা হয়।'

বিউটি বোর্ডিংয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসেন অনেকেই। এমন একজন শাহরিয়ার শিকদার।

তিনি বলেন, 'ছুটির দিনে ঘুরতে এসেছি। মুরগি, ভর্তা, সবজি, ভাত, মুড়িঘণ্ট, দই খেলাম। মোটামুটি ভালো লেগেছে।'

ভাত, বেগুন ভাজি ও মুড়িঘণ্ট। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

ঘুরতে আসা আরেক তরুণ আল আমিন তানহা বললেন, 'ইলিশের স্বাদ নেওয়া হয়নি। মুরগি, ডাল, ভর্তা, বড়া পাঁচ তরকারি দিয়ে খেলাম। এদের রান্নাগুলোয় পাঁচফোড়নের ব্যবহার আছে। সবজি, ডালে এজন্য আলাদা একটা নিজস্ব স্বাদ তৈরি হয়েছে।'

সমর সাহা জানান, প্রতিদিনই শ্যামবাজার বা শাঁখারিবাজার থেকে বাজার করেন। ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছ, মুরগি, সবজি (পাঁচ তরকারি/ লাবড়া), মুড়িঘণ্ট, বেগুন ভাজি, আমড়ার চাটনি নিয়মিত থাকে। এর বাইরে শুক্তো, চইয়ের পায়েস, আইড় মাছ, খাসির মাংসও বিভিন্ন দিন রান্না হয়।

তবে এখন সবকিছুর দাম বাড়ায় তাদেরও দাম বাড়াতে হয়েছে। বছর দুয়েক আগেও সরিষা ইলিশ ছিল ২০০ টাকা পিস। এখন সেটি ৪০০ টাকা। রুই মাছের কালিয়া ১৫০ টাকা থেকে হয়েছে ৩০০ টাকা।

দাম বাড়লেও মাছের টাটকা স্বাদ পাওয়া যাবে বলে জানান সমর সাহা।

তিনি বলেন, 'প্রতিদিন টাটকা বাজার করে রান্না এখানেই করা হয়। যে খাবার খাবেন, সেটার প্রকৃত স্বাদ পাবেন। আর এখনও প্রতি শুক্রবার আশপাশ ও দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন। পুরোনো আড্ডার আমেজটা পাওয়া যায়। আপনারাও মাঝে মাঝে আসবেন, ভালো লাগবে।'

 

Comments

The Daily Star  | English

Dozens of zombie firms still trading as if nothing is wrong

Nearly four dozen companies have been languishing in the junk category of the Dhaka Stock Exchange (DSE) for at least five years, yet their shares continue to trade on the country’s main market and sometimes even appear among the top gainers. 

5h ago