রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আর্জেন্টাইন নারী ওকাম্পের প্রেম

প্রেম মানুষকে কত দিকে নিয়ে যায়, তার ইয়েত্তা নেই। দেশ থেকে দেশান্তর হয় কবি ও কবিতা। যেমন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুদূর আর্জেন্টাইন ওকাম্পের প্রেমের কথা সাহিত্যের অনেকে জানেন। রবীন্দ্রনাথ তার সঙ্গে দেখা করার জন্য তিনি সে দেশেও গিয়েছেন। আর কবি ওকাম্পোকে ডাকতেন 'বিজয়া' নামে। তার মূল নাম ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। 

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো আর্জেন্টিনার একজন নারীবাদী লেখক ও ত্রিশের দশক থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করা সুর (Sur) নামের এক প্রগতিশীল পত্রিকার সম্পাদক। ধারণা করা হয় তার প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিল প্লেটোনিক প্রেম আর ওকাম্পোর ছিল আধ্যাত্মিক ধরার প্রেম, যা প্রতিফলিত হয়েছে তাদের সম্পর্কে। তাদের যখন দেখা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স তখন ৬৩ আর ওকাম্পোর ৩৪। 

১৯৫৯ সালের ভারতীয় সাহিত্য একাডেমি প্রকাশিত, ইন্ডিয়ান লিটারেচারের (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) ২য় সংখ্যায় ভিক্টোরিয়া একটি স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধ লিখেন যার শিরোনাম ছিল—"পশ্চিম মিলেছে পূর্বে: প্লাতা নদীর তীরে ঠাকুর" সেখানে তিনি বলেন- সেটা ছিল ১৯২৪ সাল, তিনি 'লা ন্যাশন' পত্রিকায় ৪ টি ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখছিলেন—যেগুলি ছিল 'ডানটে,' 'রুসকিন.' আর 'মহাত্মা গান্ধি,'কে নিয়ে, যেগুলি তিনি লিখে ফেলেছিলেন আর চতুর্থটি "রবীন্দ্রনাথ পড়ার আনন্দ" 

যা তখনো লেখা হয় নি—তিনি লিখছেন, সেই বসন্ত দিনে, সান ইসিড্রোতে, অলস এবং উষ্ণ, গোলাপের অসাধারণ প্রাচুর্য। সকালবেলা কাটিয়ে দিতাম আমার ঘরে, সব জানালা খোলা, গন্ধে ঠাকুর পড়া, ঠাকুরের কথা ভাবা, ঠাকুরকে লিখা, ঠাকুরের অপেক্ষায়। প্রচণ্ড প্রত্যাশার সেই দিনগুলোতে কখনোই ভাবিনি কবি সান ইসিদ্রোর পাহাড়ে আমার অতিথি হবেন। বুয়েনেস আইরেসে তার সংক্ষিপ্ত অবস্থানের সময় তিনি তার ভক্তদের সাথে দেখা করার জন্য সময় পাবেন বলে আমি আশাও করিনি; আমার 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পড়ার আনন্দ' প্রবন্ধের শিরোনাম হতে পারতো 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অপেক্ষায়'। 

প্রথম থেকেই রবীন্দ্র সাহিত্যের গুণমুগ্ধ পাঠিকা ছিলেন ওকাম্পো। রবীন্দ্রনাথ ততদিনে নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছেন। তার 'গীতাঞ্জলি' কাব্যগ্রন্থ বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। একাধিক ভাষায় লিখন এবং পঠনে পারদর্শী ওকাম্পো ইতোমধ্যেই গীতাঞ্জলী পড়ে ফেলেছেন ইংরেজি, স্প্যানিশ এবং ফরাসি ভাষায়। তার মধ্যে আঁদ্রে জিদের ফরাসি ভাষায় করা গীতাঞ্জলির অনুবাদটিই ছিল তার প্রিয়। গীতাঞ্জলি পড়ে শিহরিত হন ওকাম্পো।

পেরুর স্বাধীনতার শতবার্ষিকী উদযাপনে যোগ দিতে যাওয়ার পথে ৬ নভেম্বর ঠাকুরকে চিকিৎসা বিশ্রামের জন্য বুয়েনেস আইরেসে থামতে হয়েছিল। সেখানে কবি এক হোটেলে (প্লাসা হোটেল) ওঠলেন। তার সহযাত্রী এবং কাজের সার্বক্ষণিক সঙ্গী লেনার্ড এলমহার্স্টে ছিলে তার সঙ্গে। সেখানেই একদিন হাজির হন ওকাম্পো। ভিক্টোরিয়া ঠাকুরকে তার কাছে রেখে যত্ন নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ভিক্টোরিয়া বুয়েনেস আইরেসের শহরতলী সান ইসিড্রোতে একটি সুন্দর প্রাসাদ ভাড়া নেওয়ার জন্য তার গহনা বন্ধক রেখেছিলেন আর সেখানেই ঠাকুরকে রেখেছিলেন। চমৎকার সেই প্রাসাদের বারান্দা থেকে, প্রশস্ত সমুদ্র-সদৃশ প্লাতা নদীর অপরূপ দৃশ্য এবং লম্বা গাছ এবং ফুলের গাছের সাথে একটি বড় বাগান দেখা যেত। একটি উঁচু মালভূমির উপর বাসাটি অবস্থিত। এর সামনে আর পেছনে বিশাল প্রাঙ্গণ। সবুজ ঘাসের গালিচা মোড়া এ প্রাঙ্গণটির সৌন্দর্য ছিল অবর্ণনীয়। 

বাড়ি থেকে উত্তর দিকে কয়েক পা অগ্রসর হলেই দেখতে পাওয়া যায় তটরেখা বিহীন বিশাল নদী 'প্লাতা'। 'প্লাতা' শব্দটির অর্থ 'রূপা'। রবীন্দ্রনাথ সেই 'প্লাতা' নদীর ধারের বাসাটিতে কাটিয়েছিলেন ঘটনাবহুল প্রায় তিন মাস। 

ঠাকুর তার অসুস্থতা থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ১৯২৫ সালে ৩ জানুয়ারি বুয়েনেস আইরেস ত্যাগ করেন। যেদিন (১২ই নভেম্বর) ওকাম্পোর সঙ্গে তার জন্য নির্ধারিত বাসাটিতে পৌঁছান, সে দিনটি ছিল এমনিতেই একটু অন্যরকম। ওকাম্পোর ভাষায় – সেই বিকেলে আকাশ ক্রমেই হলুদ হয়ে আসছিল, আর বিশাল ঘন কালো মেঘ। এমন ভয়ঙ্কর গুরু মেঘ, অথচ এমন তীব্র ভাস্বর – কখনো এমন দেখিনি। আকাশ কোথাও সীসার মতন ধূসর, কোথাও মুক্তার মতো, কোথাও বা গন্ধকের মতো হলুদ, আর এতেই আরও তীব্র হয়ে উঠেছে নদীতট, আর তরুশ্রেনীর সবুজ আভা। ঊর্ধ্ব আকাশে যা ঘটেছিল, জলের মধ্যে তাই ফলিয়ে তুলেছিল নদী। কবির ঘরের বারান্দা থেকে দেখছিলাম এই আকাশ, নদী, বসন্তের সাজে ভরা প্রান্তর। বালুচরের উইলো গাছগুলি খেলা করছিল ছোট ছোট হাজারো নম্র পাতায়।'

প্লাতা নদীর তীরে এ বিখ্যাত বাড়িতেই রচিত হয়েছিল ওকাম্পো আর রবিঠাকুরের মাঝে সেই 'রহস্যময় প্রেমের' নান্দনিক উপাখ্যানগুলো। জাহাজেই কবি 'পূরবী' কাব্যগ্রন্থটি লেখতে শুরু করেন পরে যার অনেকগুলি কবিতা সেই বসাতেই লিখেছেন। হয়তো ওকাম্পোকে নিয়েই লিখেছেন 'বিদেশী ফুল'–
হে বিদেশী ফুল, যবে আমি পুছিলাম—
'কী তোমার নাম',
হাসিয়া দুলালে মাথা, বুঝিলাম তরে
নামেতে কী হবে।
আর কিছু নয়,
হাসিতে তোমার পরিচয়।
হে বিদেশী ফুল, যবে তোমারে বুকের কাছে ধরে
শুধলেম 'বলো বলো মোরে
কোথা তুমি থাকো',
হাসিয়া দুলালে মাথা, কহিলে 'জানি না, জানি নাকো'।
বুঝিলাম তবে
শুনিয়া কী হবে....
থাকো কোন দেশে।

এখানেই কবিগুরু লিখলেন 'অতিথি' 'অন্তর্হিতা', 'আশঙ্কা', 'শেষ বসন্ত'তের মত প্রেমময় অভিব্যক্তি'র কবিতা। ফ্রান্সে রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনীর একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল, আর সেজন্য ১৯৩০ সালে মার্চের শেষে তিনি যখন ফরাসি ব্যাংকার আলবার্ট খানের অতিথি হয়ে ফ্রেঞ্চ রিভেরায় গেলেন সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন তার হাতে আঁকা চারশো ছবি। ফ্রান্স তখন ছিল শিল্পের বিশ্ব রাজধানী, কবি সেখানে গিয়ে বুঝলেন, প্যারিসে ছবির প্রদর্শনী করা অত সহজ নয়। ভাল গ্যালারি এমনিতেই চট করে পাওয়া যায় না, আর তার মধ্যে আবার প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের জানাশোনাও ছিল কম।

সৌভাগ্যবশত, সেই সময়টা ওকাম্পো প্যারিসেই ছিলেন। সেটা এপ্রিলের প্রথম দিক। তিনি আসলে দেখা করতে এসেছিলেন তার জীবনের 'নতুন পুরুষ' পিয়া দ্রিউ রা হোসেলের সঙ্গে। ওকাম্পো প্যারিসে আছেন জেনে রবীন্দ্রনাথ তাকে টেলিগ্রাম করেছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন এতো মানুষের সাথে সংযোগ রাখা ওকাম্পো হয়তো কোনভাবে সাহায্য করতে পারবেন।

খবর পেয়েই চলে এলেন ওকাম্পো। রবিঠাকুরের সাথে তার দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ। এসেই খুব কম সময়ের মধ্যে পিগাল গ্যালারিতে রবিঠাকুরের ছবিগুলোর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে ফেললেন তিনি। এমনকি তার বন্ধু লেখিকা কঁতেস দ্য নোয়াইকে দিয়ে চিত্র-সূচীর একটা ভূমিকাও লিখিয়ে নিলেন ওকাম্পো। এত দ্রুত এবং সুচারুভাবে তিনি কাজগুলো সমাধান করে ফেললেন যে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল।

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, বুয়েনেস আইরেস থেকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কবিগুরুকে একটি আর্মচেয়ার উপহার দিয়েছিলেন৷ কিন্তু একটা সমস্যা হয়েছিল-- চেয়ারটা এত বড় ছিল যে জাহাজে ঠাকুরের কেবিনে ঢুকছিল না। ভিক্টোরিয়া হাল ছাড়েন নি। তিনি জাহাজের ক্যাপ্টেনকে বললেন কেবিনের দরজা ভেঙ্গে প্রবেশদ্বার বড় করতে যাতে চেয়ারটি কেবিনে যেতে পারে। ওকাম্পোই তার যোগাযোগের মাধ্যমে ঠাকুরের জন্য একটি বিশেষ দুই বেড রুমের কেবিনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯২৪ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ঠাকুর বুয়েনেস আইরেসে ওকাম্পোর অতিথি হিসাবে প্রায় দুই মাস এই চেয়ারেই বসে থাকতেন। সেই চেয়ারটি এখনও শান্তিনিকেতনে সংরক্ষিত আছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ওকাম্পোর সাথে চিঠি আদান-প্রদান করেছিলেন। ওকাম্পো সবসময় কবিগুরুকে 'প্রিয় গুরুদেব' বলে সম্বোধন করেছেন আর "আপনার বিজয়া" শেষ করেছেন। ১৯২৫ সালে কবিগুরু তার পূরবী কাব্যগ্রন্থটি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে উৎসর্গ করেন। কী সেই সম্পর্ক, অসামান্য দরদী দুজনে! 

Comments

The Daily Star  | English

Victory day today: A nation born out of blood and grit

The tide of war had turned by mid-December in 1971. The promise of freedom was no longer a dream. It had hardened into tangible certainty.

7h ago