তবে কি মৃত নগরীতে পরিণত হতে চলেছে বেঙ্গালুরু

চলতি মাসের বন্যায় বেঙ্গালুরুর বেল্লান্দুর জেলার চিত্র। ছবি: রয়টার্স

ভারতের শীর্ষ ধনীদের আবাসস্থল হিসেবে সুপরিচিত বেঙ্গালুরু। মাত্র ২ দশক আগেও এর খ্যাতি ছিল উদ্যান-হ্রদ, দৃষ্টিনন্দন ভবন ও মনোরম আবহাওয়ার নগরী হিসেবে। এখন সেসব যেন কেবলই স্মৃতি হতে চলেছে।

গত শতকের নব্বইয়ের থেকে বেঙ্গালুরু ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে ভারতের 'সিলিকন ভ্যালি'। বিশ্বের বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো আঞ্চলিক সদরদপ্তর হিসেবে বেছে নেয় কর্ণাটক রাজ্যের এই রাজধানী শহরকে। চাকরির খোঁজে লাখো কর্মী ছুটে আসেন এখানে।

এমন একটি আকর্ষণীয় শহর সময়ের আবর্তে যানজট, পানীয় জলের সংকট ও সর্বশেষ বিধ্বংসী বন্যায় 'মৃত নগরী' হতে চলেছে কি না- সেই প্রশ্ন এখন এখানকার বাসিন্দাদের মনে।

আজ বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে 'বিশ্বখ্যাত' বেঙ্গালুরুর দুর্ভাগ্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

ছবি: রয়টার্স

প্রতিবেদনে বলা হয়, আশির দশকের শেষের দিকে ভারতের প্রথিতযশা সাংবাদিক হরিশ পুলানুর সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে আসতেন বেঙ্গালুরুর পূর্ব প্রান্তে ইয়েমালুর এলাকার জনবিরল জলাভূমির পাশে।

অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি বিনষ্ট করেছে এখানকার প্রকৃতির ভারসাম্যও। সবুজের সমারোহ ঢেকে গেছে কংক্রিটের অবকাঠামোতে। বিস্তৃত জলাধার ও প্রবাহিত খালগুলো ভরাট করে আবাসন গড়ে ওঠায় এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে নগরীর কোণায় কোণায়।

প্রায় ৯০ লাখ মানুষের বেঙ্গালুরু পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে এই শহরের পানির স্তর যেমন নিচে নেমে গেছে, তেমনি সামান্য বৃষ্টিতে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।

চলতি বর্ষায় বেঙ্গালুরুতে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হওয়ায় নগরীর বিস্তীর্ণ এলাকায় কোমর-সমান জলাবদ্ধতা দেখা গেছে। যে প্রযুক্তিখাতের জন্য এ নগরীর সুখ্যাতি তা মলিন হয়েছে বহুলাংশে।

ছবি: রয়টার্স

শুধু তাই নয়, প্রতিদিনকার যানজট ও গ্রীষ্মকালে পানীয় জলের তীব্রসংকট নগরবাসীর বিরক্তি চরমে তুলে এনেছে। নগরীর অবকাঠামো নিয়ে নাগরিকদের অভিযোগ এখন পাহাড়সমান।

সাম্প্রতিক বন্যা ও জলাবদ্ধতা বেঙ্গালুরুর দ্রুতবর্ধমান নগরায়নকে আরও বড় প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যদি খরা বা বন্যা আরও প্রকট হয় তাহলে নগরীর অবস্থা কী দাঁড়াবে?

সাংবাদিক হরিশ পুলানুর বলেন, 'এটা খুবই খুবই দুঃখজনক। সুন্দর সুন্দর গাছগুলো হারিয়ে গেছে। উদ্যানগুলোও বিলীন হওয়ার পথে। এখন যেদিকে তাকাই শুধু গাড়ি আর গাড়ি।'

যে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি বেঙ্গালুরুকে সম্পদশালী করেছে এখন তারাও এই নগরীর দুরবস্থায় অভিযোগ জানাচ্ছেন। তাদের দাবি, নগরীর এক দিনের দুর্যোগ এক কোটি ডলারের ক্ষতি বয়ে আনে।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বেঙ্গালুরুতে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি আইটি প্রতিষ্ঠান আছে। 'টেক পার্ক' আছে অন্তত ৭৯টি।

এক সময়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ইয়েমালুরে এখন কাঁচ-কংক্রিটের বহুতল ভবন। সেখানে বহুজাতিক বাণিজ্যিক সংস্থা জেপি মরগানসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। আরও আছে অগণিত ভারতীয় 'স্টার্টআপ' প্রতিষ্ঠান।

ছবি: রয়টার্স

চলমান বন্যার পানি এ শহরে বসবাসকারী ভারতের শীর্ষ ধনীদের বেডরুমেও ঢুকেছিল। বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বহু কোটি রুপি। এর পরিমাণ যে দিনে দিনে আরও বাড়বে, সে আশঙ্কাও করা হচ্ছে।

ভারতের ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যন্ড সার্ভিসেস কোম্পানিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট কে এস বিশ্বনাথান সংবাদ সংস্থাটিকে বলেন, 'বৈশ্বিক প্রযুক্তি ব্যবস্থার অন্যতম কেন্দ্র ভারত। এখানে সমস্যা হলে সারাবিশ্বে এর বাজে প্রভাব পড়বে—এটাই স্বাভাবিক।'

মৃত নগরী হওয়ার পথে বেঙ্গালুরু?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ অবকাঠামোর কারণে প্রায় ২০০ লেক ও বেশ কয়েকটি খাল ভরাট হয়ে গেছে। বন্ধ হয়েছে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের পথ। বিশেষ করে, নগরীর নিম্নাঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

কর্ণাটক রাজ্য সরকার জানিয়েছে, চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গত সপ্তাহে প্রায় ৩০০ কোটি রুপি খরচ করা হয়েছে। অনুমোদন ছাড়া গড়ে তোলা ভবন ভাঙা, পানি নিষ্কাশনের জন্য নালা তৈরি ও টিকে থাকা লেকগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর খরচও এর মধ্যে আছে।

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বাসাভারাজ বোম্মাই সাংবাদিকদের বলেছেন, 'কোনো ধরনের দয়া দেখানো ছাড়াই সব দখলদারদের সরানো হবে। আমি নিজে এ কাজ পর্যবেক্ষণ করব।'

ছবি: রয়টার্স

বেঙ্গালুরুর প্রায় ৫০টি এলাকা অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে বলে সংশ্লিষ্ট নগর কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমকে জানিয়েছে। এসব এলাকায় বহু নামিদামি ভিলা ও অ্যাপার্টমেন্ট আছে, যেখানে অনেক ধনকুবেরের বাস।

বেঙ্গালুরুর যানজট কমানোর ঘোষণাও দিয়েছে রাজ্য সরকার। বলেছে, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও উন্নত করা হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব উদ্যোগ খুব একটা প্রভাব ফেলবে না।

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের বিশেষজ্ঞ রামচন্দ্র রয়টার্সকে বলেন, 'প্রতি বছর বন্যা এলে এমন কথা শুনি। আসল কথা হচ্ছে—বেঙ্গালুরু ক্ষয়ে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে এ নগরী।'

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh GDP growth vs employment

Economy expanded 50% in eight years, but jobs grew only 11%

Over the past eight years until fiscal year 2023-24, the country’s economy grew by more than 50 percent, painting a rosy picture of performance by major sectors, while the expansion did not translate into job creation.

13h ago