আইন ও নির্দেশনা উপেক্ষিত, সড়কে মৃত্যু থামছে না

আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাব বা দুর্বল বাস্তবায়নের কারণে পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা শেষ হচ্ছে না। এতে দেশের সড়কগুলো দিন দিন আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। প্রতি বছর হাজারো মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে বা আহত হচ্ছে।
সারা দেশেই লাখ লাখ ফিটনেসবিহীন ও পুরোনো গাড়ি চলছে। একদিকে যেমন দুর্বল নজরদারি, অন্যদিকে আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় অনেক চালকের লাইসেন্স না থাকলেও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো থামছে না।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের ২৪ জুলাই পর্যন্ত কমপক্ষে ৬ লাখ ২৬ হাজার যানবাহন ফিটনেস সার্টিফিকেট নবায়ন করেনি।
অন্যদিকে, ১৬ জুলাই পর্যন্ত হালনাগাদ করা বিআরটিএ'র তথ্য বলছে, ৮০ হাজার ৩০৯টি যানবাহন, যা মোট নিবন্ধিত বাণিজ্যিক যানবাহনের ২৭ শতাংশ— ইতোমধ্যেই তাদের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল পার করেছে।
সড়কে বিপুলসংখ্যক অযোগ্য ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের কারণে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির হার কমছে না।
এই প্রেক্ষাপটে, আগামীকাল সারাদেশে পালিত হতে যাচ্ছে সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনের সপ্তম বার্ষিকী— যে আন্দোলনে সাত বছর আগে এই জুলাই মাসেই হাজার হাজার মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা, এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিক্ষোভ করেছিলেন।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলায় দুই বাসের পাল্লায় বাসচাপা পড়ে দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। এই ঘটনার পরপরই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো দেশ। নজিরবিহীন এক সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলন গড়ে ওঠে।
আন্দোলনের পর তৎকালীন সরকার 'সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮' পাস করে এবং বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে সেগুলোর অধিকাংশই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
বিআরটিএ-এর তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৩ হাজার ৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ২ হাজার ৯৪৩ জন নিহত হয়েছেন। গত বছর ৫ হাজার ৮৫৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৪৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিআরটিএর আইন ও বিধিমালা প্রয়োগের ক্ষমতা এবং পেশাদারত্বের অভাব আছে।
তিনি গত শনিবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিআরটিএ অত্যন্ত দুর্বল প্রতিষ্ঠান। এর সীমাবদ্ধতাগুরো পরিবহন খাতে ক্রমবর্ধমান সমস্যাগুলোর জন্য দায়ী এবং সেগুলো সমাধান করা এখন অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।'
তিনি আরও বলেন, সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা চললেও, মোটরসাইকেল ও তিন চাকার যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদ্যমান সমস্যার সাথে নতুন চ্যালেঞ্জও যুক্ত হয়েছে, যা সড়ককে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে।
রাজনৈতিক পালাবদলের পরেও দৃশ্যমান কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন না আসার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, 'এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। বিআরটিএর সামনে পরিবর্তন আনার সুযোগ ছিল, কিন্তু তারা সেটি কাজে লাগাতে পারেনি।'
মন্তব্যের জন্য বিআরটিএ চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাউজুল কবির খান বলেছেন, সরকার আইন ও নির্দেশনাগুলো ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে।
তিনি জানান, একটি নির্দিষ্ট রুটে ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবস্থায় বাস পরিচালনার জন্য একটি পাইলট প্রকল্প ইতোমধ্যে চালু হয়েছে, যেখানে সব চালক ও কর্মীদের আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ দিতে হবে।
এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে, কিন্তু এর প্রতিবাদে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা ধর্মঘটের হুমকি দিয়েছেন।
গতকাল তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাস্তবে, তারা (পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা) এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।'
তিনি আরও বলেন, যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়বে যদি একসঙ্গে বহু যানবাহন সরিয়ে নেওয়া হয়, তাই এই সমস্যা সমাধানে পরিবহন নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
বাস্তবায়ন না হওয়া আইন ও নির্দেশনা
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে পাস হওয়া এবং ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮-তে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, পরিবহন মালিকের কাছ থেকে নিয়োগপত্র ছাড়া কাউকে চালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
পূর্ববর্তী সরকারের আমলে গঠিত একটি উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স, যা সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস ও পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছিল, তাদের একাধিক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রতিটি পরিবহন শ্রমিককে নিয়োগপত্র দিতে হবে।
তবে বাস্তাবে এই আইন ও টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত প্রায় সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয়েছে।
নিয়োগপত্র বা নির্ধারিত বেতন কাঠামোর পরিবর্তে, অনেক পরিবহন মালিক দৈনিক ভিত্তিতে চালক নিয়োগ করে এবং ট্রিপের সংখ্যার ভিত্তিতে তাদের বেতন দেয়।
ফলে, বিশেষ করে রাজধানীতে চালকরা প্রায়ই বেশি যাত্রী তোলা এবং বেশি ভাড়া আদায়ের জন্য বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়েন, যা ব্যাপকভাবে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে উঠে আসে।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে যখন সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়ন করা হয়, তখন ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন রোধ এবং সড়ক নিরাপত্তা উন্নত করার লক্ষ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য একটি ডিমেরিট পয়েন্ট সিস্টেমও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
এই পদ্ধতিতে প্রত্যেক চালককে ১২ পয়েন্ট বরাদ্দ করা হতো, প্রতিবার আইন লঙ্ঘনের জন্য এক বা দুটি পয়েন্ট কেটে নেওয়া হতো। সব পয়েন্ট শেষ হয়ে গেলে লাইসেন্স বাতিল করার বিধান ছিল।
প্রায় সাত বছর পেরিয়ে গেলেও এই ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হয়নি। বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা জানান, এই ব্যবস্থা প্রায় প্রস্তুত এবং তারা ইতোমধ্যেই পুলিশ বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, কিন্তু এখনও এটি চালু করা হয়নি।
গত বছরের মে মাসে, সরকার মোটরযানের গতিসীমা নির্দেশিকা-২০২৪ চালু করে, যার লক্ষ্য ছিল দ্রুতগতির যান নিয়ন্ত্রণ, যা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ।
এই নির্দেশিকা অনুসারে, এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি, বাস এবং মিনিবাসের গতিসীমা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে মোটরসাইকেলের জন্য ৬০ কিলোমিটার এবং ট্রাকের জন্য ৫০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা।
জাতীয় মহাসড়কে গাড়ি, বাস এবং মিনিবাসের জন্য ৭০ কিলোমিটার, মোটরসাইকেলের জন্য ৫০ কিলোমিটার এবং ট্রাক এবং আর্টিকুলেটেড লরির জন্য ৪৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা।
এই সীমা লঙ্ঘন করলে যে কেউ সড়ক পরিবহন আইনের অধীনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন, যার মধ্যে তিন মাসের কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ড অন্তর্ভুক্ত।
তবে, গত বছরে এই নির্দেশিকাটি কার্যত উপেক্ষিত হয়েছে। শুধুমাত্র ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মতো নির্বাচিত কিছু রাস্তায় এর সীমিত প্রয়োগ দেখা গেছে।
এদিকে, স্থানীয়ভাবে তৈরি ধীরগতির তিন চাকার যানবাহনগুলো যখন উচ্চগতির যানবাহনের সাথে মহাসড়কে চলাচল করে, তখন তা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই বিষয়টি বিভিন্ন তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এবং এনজিও সংস্থাগুলোর সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এই প্রেক্ষাপটে, ২০১৫ সালের আগস্টে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় ২২টি প্রধান মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
পরবর্তীতে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে হাইকোর্ট সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সারা দেশে মহাসড়কে এই ধরনের অস্থায়ী তিন চাকার যানবাহন চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
তবে বাস্তবে এসব যানবাহন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় মহাসড়কে চলাচল করছে, কারণ তারা একে দ্রুত অর্থ উপার্জনের সহজ উপায় হিসেবে দেখেন।
Comments