দেশে ব্যবহার হচ্ছে ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ ১৭ কীটনাশক
বিশ্বজুড়ে অত্যন্ত বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত অন্তত ১৭টি কীটনাশক উপাদান বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব কীটনাশক জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে বলে এক নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এই রাসায়নিকগুলোকে 'অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কীটনাশক' হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এসব কীটনাশক স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
এই গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে এমন ২৫টি ঝুঁকিপূর্ণ কীটনাশক নিবন্ধিত রয়েছে। এর মধ্যে ১৭টির উপস্থিতি ও ব্যবহারের কথা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করেছেন।
গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটির অর্থায়নে পরিচালিত এই গবেষণা অনুসারে, এগুলোর মধ্যে ছয়টি কীটনাশক, পাঁচটি ছত্রাকনাশক, চারটি আগাছানাশক এবং দুটি ইঁদুরনাশক রয়েছে। এই সংস্থাটি পরিবেশ সুরক্ষায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অনুদান ও নীতিগত সহায়তা দিয়ে থাকে।
গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া কীটতত্ত্ববিদ ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) অধ্যাপক গোপাল দাস বলেন, 'যেকোনো কীটনাশক যা মানুষ বা পরিবেশের গুরুতর বা স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে, তাকেই অত্যন্ত বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।'
গবেষণা অনুযায়ী, দেশে বহুল ব্যবহৃত ১০টি ঝুঁকিপূর্ণ কীটনাশক হলো—প্যারাকোয়াট, গ্লাইফোসেট, ক্লোরপাইরিফস, অ্যাবামেকটিন, অ্যাসিটোক্লোর, জিঙ্ক ফসফাইড, ব্রোমাডিওলোন, কার্বেনডাজিম এবং প্রোপিকোনাজোল। বাকি সাতটি—ক্যাডুসাফস, থিয়াক্লোপ্রিড, স্পিরোডিক্লোফেন, ডাইমেথোমর্ফ, বিটা-সাইফ্লুথ্রিন, সাইপ্রোকোনাজোল এবং এডিফেনফস। এগুলো মাঝারি বা স্বল্প পরিমাণে ব্যবহৃত হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব কীটনাশকের অনেকগুলোই ক্যানসার ও দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করতে পারে। এর মধ্যে কয়েকটি জলজ প্রাণী, পাখি এবং মৌমাছির মতো পরাগায়নকারী প্রাণীর জন্য অত্যন্ত বিষাক্ত।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত সদস্যের গবেষক দল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ে নিবন্ধিত আরও আটটি বিপজ্জনক কীটনাশক চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো ইথোপ্রোফস, সাইফ্লুথ্রিন, ট্রায়াজোফস, মিথাইল ব্রোমাইড, ট্রাইক্লোরফন, ডাইইউরন, ইপোক্সিকোনাজোল এবং ফ্লুসিলাজোল।
তবে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত জরিপ চলাকালে তারা ডিলারদের দোকান বা ফসলের মাঠে এসব কীটনাশকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
বর্তমানে উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ে ৮ হাজারের বেশি কীটনাশক পণ্য নিবন্ধিত রয়েছে।
বিপজ্জনক কীটনাশকগুলোর মধ্যে প্যারাকোয়াট বাংলাদেশে কৃষকরা অহরহ ব্যবহার করেন, যদিও এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রসহ ৪০টিরও বেশি দেশে নিষিদ্ধ।
২০২৩ সালের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের ৭৭ শতাংশ কৃষক সবজিতে কীটনাশক ব্যবহার করেন। তাদের ৮৭ শতাংশই কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া কীটনাশক ছিটান। যারা কীটনাশক ব্যবহার করেছেন, তাদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ একবার, ৩১ শতাংশ দুইবার এবং বাকিরা একাধিকবার সবজিতে রাসায়নিক স্প্রে করেছেন। কেউ কেউ একটি ফসলের পুরো মৌসুমে ১৭ থেকে ১৫০ বার পর্যন্ত কীটনাশক ব্যবহার করেছেন।
বাকৃবির চার অনুষদের শিক্ষক এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের একজন চিকিৎসকের তৈরি করা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, পরীক্ষা করা ১,৫৭৭টি শীতকালীন সবজির নমুনার মধ্যে ৩০ শতাংশে কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে এবং ৭৩ শতাংশ নমুনায় এর মাত্রা ছিল কেজিতে ০.০৫ মিলিগ্রামের বেশি, যা নিরাপদ সীমার বাইরে। লাউয়ের শতভাগ, শিমের ৯২ শতাংশ, টমেটোর ৭৮ শতাংশ এবং বেগুনের ৭৩ শতাংশ নমুনায় কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ক্যানসারসহ নানা স্বাস্থ্য জটিলতা তৈরি করছে। এ বছরের মার্চে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, কীটনাশকের সংস্পর্শে এসে বাংলাদেশের প্রায় ৩৫ শতাংশ কৃষক বমি বমি ভাব, মাথাব্যথা ও শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যায় ভোগেন।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে কীটনাশকযুক্ত খাবার খেলে ক্যানসার, স্নায়বিক সমস্যা ও লিভারের রোগ হতে পারে।
সম্প্রতি একদল হেমাটোলজিস্টের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুন মাসের মধ্যে ঢাকার সাতটি ক্যানসার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৪৩০ জন রোগীর মধ্যে অন্তত ১৫০ জন ফসলের মাঠে কীটনাশক ব্যবহার করতেন।
গবেষণার নেতৃত্বদানকারী ক্যানসার বিশেষজ্ঞ আমিন লুৎফুল কবির বলেন, 'আমাদের অনেক রোগীই কৃষক, যাদের কীটনাশক ব্যবহারের ইতিহাস রয়েছে... তবে কীটনাশক ব্যবহারকারী প্রত্যেকেই যে ক্যানসারে আক্রান্ত হবেন তা নয়। এটি মূলত ব্যবহারকারীর শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে।'
এই প্রতিবেদক কিশোরগঞ্জের একজন কৃষক মো. মোক্তার উদ্দিনের (৬৫) সঙ্গে কথা বলেছেন, যার ক্যানসার ধরা পড়েছে। শৈশব থেকে কৃষিকাজ করছেন তিনি।
কীটনাশক স্প্রে করার সময় মাস্ক পরতেন কি না জানতে চাইলে মোক্তার বলেন, তিনি সুরক্ষার জন্য সবসময় মুখের চারপাশে এক টুকরো কাপড় জড়িয়ে নিতেন।
বাংলাদেশ ক্রপ প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিপিএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে কীটনাশকের ব্যবহার ও উৎপাদনকারী—দুটিই বাড়ছে। গত বছর কৃষকেরা ৪০ হাজার ৮৩২ টন কীটনাশক ব্যবহার করেছেন, যা আগের বছরে ছিল ৩৮ হাজার ৬৪৮ টন। ২০১০ সালে কীটনাশক কোম্পানির সংখ্যা ছিল ১২৪, যা এখন বেড়ে ৯০০তে দাঁড়িয়েছে।
অধ্যাপক গোপাল দাস বলেন, 'কোম্পানির সংখ্যা যত বাড়বে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা তত কঠিন হবে।'
উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের উপপরিচালক (কীটনাশক) মুহাম্মদ শাহ আলম জানান, গত বছরের ডিসেম্বরে তারা প্যারাকোয়াট ও গ্লাইফোসেটযুক্ত নতুন কোনো পণ্যের নিবন্ধন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বর্তমানে এই দুটি উপাদান দিয়ে তৈরি ১৮৭টি পণ্য বাজারে রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ১৯৬০ সাল থেকে ১৯টি সক্রিয় কীটনাশক উপাদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বিপজ্জনক কীটনাশকগুলো নিষিদ্ধ করা হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, কীটনাশক কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির পরবর্তী বৈঠকে এগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে বৈঠকের কোনো নির্দিষ্ট তারিখ তিনি জানাতে পারেননি।
অধ্যাপক গোপাল দাস বলেন, বাজার থেকে বিপজ্জনক কীটনাশক পর্যায়ক্রমে অপসারণ করতে সরকারকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি বলেন, 'সরকার এক রাতের মধ্যে সব নিষিদ্ধ করতে পারবে না। প্রথমে বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে। অন্যথায়, খাদ্য নিরাপত্তায় প্রভাব পড়বে।'
তিনি আরও বলেন, কীটনাশক কেনা-বেচার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। একজন কৃষক যত খুশি কীটনাশক কিনে ব্যবহার করতে পারেন। মাঠপর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তদারকি জোরদার এবং কৃষকদের জন্য নিরাপদ কীটনাশক ব্যবহারের প্রশিক্ষণ চালুর ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
(সংক্ষেপিত অনুবাদ, মূল প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে)


Comments