কালোবাজারি ও সিন্ডিকেট বন্ধে সার বিতরণে সরকারের নতুন নীতিমালা
কালোবাজারি ও সিন্ডিকেট বন্ধের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে সময়মতো নির্ধারিত দামে সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ সংক্রান্ত নীতিমালা ২০২৫ জারি করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
দেশের কৃষকরা অনেকদিন ধরেই সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সার কেনার অভিযোগ করার পর এই পদক্ষেপ নেওয়া হলো। বিশেষ করে বোরো মৌসুমে ধান চাষের জন্য এই পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারি তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫০ লাখ টনেরও বেশি রাসায়নিক সার ব্যবহার করেছে।
নতুন নীতির অধীনে সব ডিলারকে সরকার নিযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
এ ছাড়া, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ডিলার এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ডিলারদের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, ইউনিয়ন ও পৌরসভাগুলোতে প্রতি তিনটি ওয়ার্ডের জন্য একটি করে ডিলার ইউনিট গঠন করা হবে। যার মধ্যে প্রতি ইউনিয়ন বা পৌরসভায় সর্বাধিক তিনজন ডিলার থাকতে পারবে, প্রতি ইউনিটে একজন।
বিদ্যমান বিসিআইসি ও বিএডিসি ডিলারদের দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করা হবে এবং খালি ইউনিটগুলো নতুন নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করা হবে, উল্লেখ করা হয়েছে নীতিমালায়।
সিটি করপোরেশন এলাকায় উল্লেখযোগ্য ফসলি জমি থাকলে ও ডিলার নিয়োগ যৌক্তিকভাবে প্রয়োজন হলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সুপারিশ ও কেন্দ্রীয় সার ডিলার ব্যবস্থাপনা কমিটির অনুমোদনের ভিত্তিতে ডিলার নিয়োগ করা যেতে পারে।
প্রতিটি ইউনিয়ন স্তরের ডিলারকে তাদের তিনটি নির্ধারিত ওয়ার্ডের প্রতিটিতে একটি করে খুচরা বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে, বলা হয়েছে নীতিমালায়।
পৌর এলাকার ডিলাররা সর্বাধিক তিনটি খুচরা বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করবে এবং সিটি করপোরেশনের ডিলাররা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে সুবিধাজনক স্থানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কেন্দ্র স্থাপন করবে।
নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, আলাদাভাবে কোনো সাব-ডিলার বা খুচরা ডিলার থাকবে না।
তবে, বিদ্যমান সাব-ডিলার বা খুচরা সার বিক্রেতারা এই নীতিমালা জারির পর ৩১ মার্চ ২০২৬ তারিখের মধ্যে তাদের সব দায়-দেনার নিষ্পত্তি করবেন। এ ছাড়া ২০২৬ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সাব-ডিলার বা খুচরা সার বিক্রেতারা আগের নিয়মে সার ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে।
এই মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পর ডিলারগণ কৃষক ব্যতীত কোনো খুচরা বিক্রেতার নিকট সার বিক্রয় করতে পারবে না। ডিলার তার জন্য নির্ধারিত নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র ব্যতীত অন্য কোনো স্থান বা কারো মাধ্যমে সার বিক্রয় বা সরবরাহ করতে পারবে না, বলা হয়েছে নতুন নীতিমালায়।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, সার ডিলার নিয়োগের ক্ষেত্রে একই পরিবারের একজনের ডিলারশিপ থাকলে অন্য কেউ আবেদন করতে বা ডিলার থাকতে পারবেন না।
"নতুন নীতিমালা টেকসই নাও হতে পারে"
দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ এই নীতিমালা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, বর্তমানে ডিলাররা প্রতি কেজিতে দুই টাকা কমিশন পান, যার মধ্যে পরিবহন খরচও রয়েছে। এই কমিশন ২০০৮ সালে নির্ধারণ করা হয়েছিল। তারপর থেকে পরিবহনসহ অন্যান্য খরচ প্রতি কেজিতে চার টাকার বেশি বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, নতুন নীতিমালার অধীনে একজন ইউনিয়ন ডিলারকে আরও দুটি স্টোরেজ সেন্টার স্থাপন করতে হবে। যার ফলে খরচ আরও বাড়বে। এ বিষয়টি সমাধান না করলে নীতি টেকসই নাও হতে পারে।
আহমেদ আরও বলেন, কেবল প্রতি ইউনিয়নে ডিলারের সংখ্যা বাড়ালেই দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। জেলাপর্যায়ে সরবরাহ না বাড়ালে দাম বাড়বে। সরবরাহ ঠিক রাখাটাই প্রধান বিষয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও পর্যবেক্ষণ শাখার যুগ্ম সচিব খোরশেদ আলম বলেন, নতুন নীতিমালার অধীনে সব সার ডিলারকে একই ছাতার নিচে আনা হয়েছে।
একই ডিলার এখন ইউরিয়া এবং নন-ইউরিয়া উভয় সারই বিক্রি ও সরবরাহ করবেন, বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, পূর্বে বিসিআইসি এবং বিএডিসি ডিলারদের মধ্যে একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা ছিল, যাতে ব্যবস্থাপনায় সমস্যা তৈরি হয়েছিল। ডিলার ইউনিটগুলোও স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত ছিল না।
এ নীতি বাস্তবায়ন করা হলে কৃষিখাতে বৈপ্লবিক উন্নয়ন হবে বলে মনে করেন তিনি।
নীতিমালার মূল লক্ষ্য কৃষকদের দোরগোড়ায় সরাসরি সার পৌঁছে দেওয়া এবং কালোবাজারি বা দামের হেরফের বন্ধ করা বলে জানান খোরশেদ আলম।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, সরকারের লক্ষ্য হলো কৃষক-বান্ধব সার ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা তৈরি করা। একটি সিন্ডিকেট তাদের সুবিধার জন্য বণ্টনে কারসাজি করে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের বাজেটের প্রায় ৬৫ শতাংশ সারের পেছনে ব্যয় হয়। সরকার যদি এত টাকা ব্যয় করে, তাহলে কৃষক যেন উপকৃত হয় সেটাই এই নীতিমালার প্রধান লক্ষ্য, বলেন তিনি।
নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে বছরে সরকারের তিন হাজার থেকে চার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, সরকার প্রায় দুই হাজার ডিলার চিহ্নিত করেছে, যাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, সার ডিলার নিয়োগ এবং বিতরণের সামগ্রিক তত্ত্বাবধান কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসা একটি উল্লেখযোগ্য এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
নীতিটি সময়োপযোগী, তবে সরকারকে অবশ্যই কৃষকদের সত্যিকার অর্থে উপকৃত করতে এবং কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য সারের ধারাবাহিক প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে, বলে মনে করেন তিনি।


Comments