মেমোরি কার্ড কেলেঙ্কারি: ৫ বছরেও শেষ হয়নি তদন্ত
আমদানি নিষিদ্ধ মেমোরি কার্ড অবৈধভাবে খালাসের ঘটনায় জড়িতদের গত পাঁচ বছরেও জবাবদিহির আওতায় আনতে পারেনি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
স্টক-লট হিসেবে আনা এই মেমোরি কার্ডের বাজারমূল্য ৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা হলেও তা ঢাকা কাস্টমস হাউসের তৎকালীন কমিশনার মোয়াজ্জেম হোসেন মাত্র ৩১ লাখ ৭০ হাজার টাকা শুল্ক ও জরিমানা দিয়ে ছেড়ে দেন।
এ ঘটনায় আর্থিক অনিয়মের চেয়ে নিষিদ্ধ পণ্য ছাড়িয়ে নেওয়া এবং পরবর্তীতে অভিযুক্তদের বাঁচানোর জন্য রাষ্ট্রীয় তদন্ত প্রক্রিয়ায় ধীরগতি বড় প্রশ্ন উঠেছে।
গত পাঁচ বছরে দুদকের তিনজন তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু তদন্তের অগ্রগতি চোখে পড়েনি।
নতুন আইও দুদকের উপপরিচালক মো. আসাদুজ্জামান গত অক্টোবরে দায়িত্ব নিলেও তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেননি বলে জানান তিনি।
এরই মধ্যে ২০২৩ সালে দুদক সাতজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। তাদের মধ্যে আছেন আমদানিকারক মামুন হাওলাদার, কাস্টমসের দুই কর্মকর্তা এবং আমদানি–রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের (সিসিআইই) চার কর্মকর্তা।
মামলার নথি বলছে, মামুন ঢাকা বিমানবন্দর দিয়ে ২ লাখ ১০ হাজার নিষিদ্ধ মেমোরি কার্ড আনেন। পরে কাস্টমসের দুই কর্মকর্তার সহযোগিতায় গুদাম থেকে বের করে নেন।
অভিযোগে বলা হয়, সিসিআইইর চার কর্মকর্তা এই পণ্যের ছাড়পত্র (সিপি) জারি করেন। তারা হলেন—সহকারী নিয়ন্ত্রক মামুন ইফতেখার রহমান ও ফাতেমা খাতুন, উপ-নিয়ন্ত্রক মনিরুজ্জামান খান এবং নিয়ন্ত্রক আউলাদ হোসেন।
তবে পরবর্তীতে তদন্ত কর্মকর্তা সুবেল আহমেদ 'প্রমাণের অভাব' দেখিয়ে তাদের চারজনকে অব্যাহতি দেন।
তিনি উল্লেখ করেন, 'সিপিতে সুস্পষ্টভাবে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য ছাড় করা যাবে না উল্লেখ করা ছিল, বিধায় এ দপ্তরের কোনো দায় নেই।'
দুদক সেই প্রতিবেদন বাতিল করে জানায়, তদন্তে 'গুরুতর ত্রুটি' ছিল এবং দায়ীদের চিহ্নিত করা হয়নি।
অভিযুক্ত সিসিআইই কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, দুদক কাস্টমসের যেসব কর্মকর্তা পণ্য ছাড় দিয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদই করেনি। বরং তদন্ত দীর্ঘায়িত করা হয়েছে আসল অপরাধীদের আড়াল করার জন্য।
কাস্টমসের নথিতে দেখা যায়, ক্লিয়ারেন্স পারমিটে (সিপি) স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ পণ্য ছাড় না করার নির্দেশ থাকলেও ২০২০ সালের ১ মার্চ তৎকালীন ঢাকা কাস্টমস কমিশনার মোয়াজ্জেম হোসেন তা ছাড় দেন। গত পাঁচ বছরে দুদক কিংবা এনবিআর কোনো সংস্থাই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। যদিও এনবিআরের নীতি বিভাগের তদন্তে মোয়াজ্জেম হোসেনের বিচারাদেশ অবৈধ উল্লেখ করেছিল।
অবশ্য মোয়াজ্জেম অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এ বিষয়ে জানতে আমদানিকারক মামুনকে ফোন ও ম্যাসেজ পাঠানো হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
এর আগে, ২০১৬ সালের ১১ জুন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মামুন হাওলাদারের কাছ থেকে মেমোরি কার্ডগুলো জব্দ করে কাস্টমস। পরের বছরের ১৬ জানুয়ারি মামুন সিপি না থাকার কথা স্বীকার করলে চোরাচালান আইনে এসব পণ্য বাজেয়াপ্ত করা হয়।
এরপর চার বছর পেরিয়ে যায়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আদালত শর্তসাপেক্ষে পণ্য ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন। শর্ত ছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সিপি নিতে হবে। এর এক মাসের মধ্যেই মামুন সেই ছাড়পত্র পান, যদিও দুদক ছাড়পত্রটিকে অবৈধ বলেছিল।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এনবিআরের নীতি বিভাগ থেকে অতিরিক্ত কমিশনার মো. মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের কমিটি করে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য। ১৪ সেপ্টেম্বর দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, "পণ্য চালানটি 'স্টক-লট' হিসেবে আনা হয়েছিল এবং আমদানি নীতি আদেশ অনুযায়ী এটি নিষিদ্ধ।"
এছাড়া পণ্য গুদাম থেকে চুরি বা অপসারণের ঘটনায় কাস্টমস কর্মকর্তাদেরও দায়ী করে এ কমিটি।
যোগাযোগ করা হলে মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, 'এই পণ্য যে স্টক-লট হিসেবে এসেছে, তা তার অজানা ছিল।'
তিনি বলেন, 'আমদানিকারক বিষয়টি গোপন করেছিল। আদালতের আদেশ ছিল, আমি শুধু সেটাই কার্যকর করেছি।'
তবে নিয়ম অনুযায়ী, ঘোষিত মূল্য বা কাস্টমসের নির্ধারিত ভ্যালুর মধ্যে যেটি বেশি, সে অনুযায়ী শুল্ক নির্ধারণের কথা থাকলেও এই চালানে আমদানিকারকের ক্রয় রশিদ অনুযায়ী শুল্ক নির্ধারণ হয়। এতে রাজস্ব আদায় হয় মাত্র ২১ লাখ ৭০ হাজার টাকা, অথচ এখানে প্রায় ৩ কোটি টাকার মতো আদায় হওয়ার কথা ছিল। জরিমানাও ধরা হয় মাত্র ১০ লাখ টাকা।
কেন ক্রয় রশিদের 'স্টক-লট' লেখা থাকা সত্ত্বেও তা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে মোয়াজ্জেম বলেন, 'বিষয়টি সংশ্লিষ্ট অ্যাসেসমেন্ট গ্রুপের। চালানটি বহুদিন আটকে ছিল এবং আদালতের নির্দেশও ছিল। বিস্তারিত যাচাই করার মতো সময় তখন পাওয়া যায়নি।'


Comments