সিন্ডিকেট করে শ্রমিক বঞ্চনা, মালয়েশিয়ার দিকে অভিযোগের তীর বাংলাদেশের

গত শুক্রবার মালয়েশিয়ায় অভিবাসী কর্মী প্রবেশের দিন শেষ দিন হওয়ায় হাজার হাজার প্রবাসী সেদিন ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে ভিড় করেন। ভিসা থাকলেও সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় প্রায় ১৭ হাজার কর্মী যেতে পারেননি মালয়েশিয়া। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর জন্য দেশের লাইসেন্সধারী এক হাজার ৫২০ রিক্রুটিং এজেন্সিকে অনুমোদন দিতে চেয়েছিল ঢাকা। কিন্তু কুয়ালালামপুর এগুলোর মধ্যে মাত্র ১০১টি এজেন্সিকে বাছাই করে।

মালয়েশিয়ায় প্রবাসীকর্মীদের পাঠানোর ক্ষেত্রে যে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে এবং শ্রমিকদের ওপর যে নিপীড়ন হয়েছে তার পেছনে কুয়ালালামপুরের এ সিদ্ধান্তকে দায়ী করছেন জনশক্তি রপ্তানি খাত সংশ্লিষ্টরা।

প্রবাসী কর্মীদের বঞ্চনার বিষয়ে গত ২৮ মার্চ জাতিসংঘের চার বিশেষজ্ঞের দেওয়া চিঠির জবাবে জেনেভায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন জানায়, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর শ্রমিক নিয়োগের বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) সই করে।

পরের বছরের ১৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দিয়ে ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সি বাছাই করতে বলে।

এর জবাবে মন্ত্রণালয় ১৮ জানুয়ারি মালয়েশিয়ান মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে দেশের লাইসেন্সপ্রাপ্ত সব রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য সুযোগটি উন্মুক্ত রাখার অনুরোধ জানায়।

চিঠিতে বলা হয়, 'মাননীয় মন্ত্রী সুযোগটি উন্মুক্ত রাখার দিকে নির্দেশ করছেন যা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) স্ট্যান্ডার্ডের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা কমিশন আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেহেতু এতে স্বচ্ছ ও পক্ষপাতহীন প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা যাবে।'

পরে ২০২৩ সালের ২০ মার্চ যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বাংলাদেশ একই বিষয়ের ওপর আবার জোর দেয়। কিন্তু, মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ তাদের পছন্দ ও আদেশ অনুযায়ী নিয়োগকারী সংস্থার সংখ্যা ২৫টি থেকে বাড়িয়ে ১০১টিতে নেয়। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয় বলে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন জানায়।

মালয়েশিয়ায় প্রবাসী কর্মীদের বেকারত্ব, ঋণগ্রস্ততাসহ নানা ধরনের শোষণ ও বঞ্চনার অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশের পর নিয়োগের এসব বিষয় আবার সামনে আসে এবং পরিশেষে গত ৩১ মে থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দিতে হয় দেশটিকে।

২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় গেছেন। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষকে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে প্রবাসী কর্মীদের নিয়োগে ফি হিসেবে সাড়ে ৪ থেকে ৬ হাজার ডলার পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে।

এমনকি নিয়োগের ক্ষেত্রে যে মালয়েশিয়ার সরকারি কর্মকর্তা, এজেন্ট ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন ঘুষ নিয়েছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

এভাবে নিয়োগ পেতে গিয়ে নিঃস্ব হওয়া ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে জীবনযাপন করা হাজারো কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান বিশেষজ্ঞরা। কর্মীদের অবস্থার উন্নতির জন্য দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা, নীতিমালা ও তদন্তের বিষয়ে দুই দেশ কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, সে সম্পর্কেও খোঁজ নেন তারা।

কিন্তু ৬০ দিনের মধ্যে কোনো দেশ সাড়া না দেওয়ায়, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার অফিস গত ২৭ মে চিঠিগুলো প্রকাশ করে। পরে জেনেভায় জাতিসংঘে মালয়েশিয়ার স্থায়ী মিশন ২৮ মে এবং পরদিন বাংলাদেশ মিশন জবাব দেয়।

জবাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, বাংলাদেশের ১০১ রিক্রুটিং এজেন্সি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কীভাবে মালয়েশিয়া হস্তক্ষেপ করেছে।

কর্মী নিয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এই ১০১ এজেন্সির সিন্ডিকেটের নেতাদের মোটা অংকের টাকা দিতে পারলেই নিয়োগের জন্য বাছাই করা হতো।

বাংলাদেশ মিশন বলে, নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়েছে অনলাইন সিস্টেম ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (এফডব্লিউসিএমএস) মাধ্যমে, যা মালয়েশিয়ার সরকার তৈরি ও পরিচালনা করেছে।

মিশনের চিঠিতে বলা হয়, 'এর ফলে ভুয়া ভিসা ব্যবহার করে কোনো বাংলাদেশি কর্মীকে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর সুযোগ থাকার কথা না।'

কিন্তু মালয়েশিয়ার গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, মালয়েশিয়া সরকার এফডব্লিউসিএমএস সিস্টেম পরিচালনার দায়িত্ব দেয় বিতর্কিত আইটি কোম্পানি বেস্টিনেটকে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদেশি কর্মী নিয়োগের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ ও জালিয়াতির পেছনে প্রধান ভূমিকা বেস্টিনেটের প্রেসিডেন্ট আমিনুল ইসলাম আবদুল নরের।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের কাছে দেওয়া বাংলাদেশের চিঠিতে বলা হয়, ২০২২ সালের আগস্টে শ্রমিক নিয়োগের প্রথম ধাপে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন চাকরির চাহিদাপত্র সত্যায়িত করার আগে তা যাচাইয়ের জন্য নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করত।

কিন্তু পরে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে বাংলাদেশ মিশন এ ধরনের পরিদর্শন বন্ধ রাখে।

দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ মিশনকে জানায়, প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারে পড়ে।

যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বাংলাদেশ নতুন যাওয়া বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগ না পাওয়ার বিষয়টি উত্থাপন করে এ বিষয়ে মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানায় বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

মিশনের চিঠিতে আরও বলা হয়, মালয়েশিয়ার শ্রম বিভাগ বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ৪৮ নিয়োগদানকারী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদেশি কর্মী নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দেয়।

জাতিসংঘে মালয়েশিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি নাদজিরাহ ওসমানের দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, মালয়েশিয়ার শ্রম বিভাগ ২০২৩ সালে এক হাজার ৬৬৪ প্রবাসী কর্মী এবং এ বছর ৯১০ কর্মীকে নতুন করে চাকরি দিয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, কর্মী নিপীড়নের ফাঁকফোকর বন্ধ করতে এবং মালয়েশিয়ায় বিদেশি কর্মীদের চাহিদা নতুন করে হিসাব করতে মালয়েশিয়া ৩১ মে থেকে বিদেশি কর্মী প্রবেশ সীমিত করে।

মালয়েশিয়ায় প্রবাসী কর্মীদের অধিকার রক্ষায় কুয়ালালামপুরের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

14 arrested over attacks, clashes in Gopalganj

At least 14 people have been arrested so far in connection with yesterday’s attack on NCP rally and subsequent clashes with law enforcers

13m ago