প্রশাসনসহ সাধারণ ক্যাডারে এক-তৃতীয়াংশ চিকিৎসক-প্রকৌশলী

সরকারি চাকরির প্রশাসন, পররাষ্ট্র ক্যাডারের মতো কয়েকটি সাধারণ ক্যাডারের চাহিদা এতটাই বেড়েছে যে মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিশেষায়িত ক্ষেত্রগুলো ছেড়ে সেখানকার গ্র্যাজুয়েটরা সাধারণ ক্যাডার সার্ভিসে নিজেদেরকে যুক্ত করছেন।

বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) তথ্য অনুযায়ী, গত অন্তত তিনটি বিসিএস পরীক্ষায় সাধারণ ক্যাডারে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের প্রায় ৩০ শতাংশ মেডিকেল কলেজ বা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী।

শিক্ষাবিদ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, সরকার মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীদের পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে এবং তারা যে দক্ষতা অর্জন করে তা দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা করা এই অধ্যাপক বলেন, এ ধরনের গ্র্যাজুয়েটরা সাধারণ ক্যাডার বেছে নিলে জ্ঞান ও দেশের সম্পদের অপচয় হয়।

প্রশাসনিক ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা, দ্রুত পদোন্নতি এবং নন-অ্যাডমিন ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রতি বৈষম্যের কারণেই গ্র্যাজুয়েটরা সাধারণ ক্যাডারের দিকে ঝুঁকছেন বলে জানান একাধিক আমলা।

পিএসসি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে ১৮৩ জন প্রকৌশলী ও ২৫ জন চিকিৎসক নিয়োগ পেয়েছেন, যা মোট নিয়োগের ৩২ দশমিক ২৪ শতাংশ।

৪০ ও ৪১তম বিসিএসেও একই ধরনের প্রবণতার তথ্য মিলেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরা তাদের বিশেষায়িত ক্ষেত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এটি একটি নতুন ঘটনা। অতীতে এমনটা ছিল না।'

'এটি ইঙ্গিত দেয় যে মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের চাকরিকে বেশি লাভজনক বলে মনে করছেন।'

বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে ১৩টি সাধারণ ক্যাটাগরির ক্যাডার সার্ভিসের মধ্যে প্রশাসন, পুলিশ ও পররাষ্ট্র সার্ভিস রয়েছে। অন্যদিকে বিসিএসের ১৩টি বিশেষায়িত ক্যাটাগরির মধ্যে রয়েছে প্রকৌশল, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ইত্যাদি। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকরা সাধারণ ক্যাডারের অর্থাৎ প্রশাসন, পুলিশ ও ফরেন সার্ভিস ক্যাডারের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন। অন্যদিকে প্রকৌশল বা স্বাস্থ্য ক্যাডারের পরীক্ষায় শুধু বিশেষায়িত ডিগ্রিধারীরা অংশ নেওয়ার যোগ্যতা রাখেন।

সাধারণ ক্যাডার এত জনপ্রিয় কেন?

৪১তম বিসিএসে ৩৬ হাজার ৯৮ জন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ২২ হাজার ৭১৫ জন মেডিকেল গ্র্যাজুয়েট সাধারণ ক্যাডারে চাকরির জন্য আবেদন করেন এবং ৪৩তম বিসিএসে ৪৭ হাজার ৩১৫ জন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ১৫ হাজার ৬৬৫ জন মেডিকেল গ্র্যাজুয়েট চাকরির জন্য আবেদন করেন।

পিএসসির একজন কর্মকর্তা জানান, ৪৩তম বিসিএসে চিকিৎসকদের আবেদনের সংখ্যা কমেছে কারণ আগের বিসিএসে শুধুমাত্র চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তখন ৩১ হাজার ২৬ জন আবেদনকারীর মধ্যে থেকে ৪ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

তিনি বলেন, এটা সবাই জানেন যে প্রশাসনের কর্মকর্তারা অন্যদের ওপর আধিপত্য চালান। তাদের শীর্ষ পদে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

মেডিকেল বিষয়ে স্নাতক করে ফরেন সার্ভিসে যোগ দেওয়া এক কর্মকর্তা জানান, একজন ফরেন সার্ভিস অফিসার বিদেশে পোস্টিং হলে বাড়তি সুবিধা পান। উন্নত দেশে যারা নিয়োগ পাবেন, তারা তাদের সন্তানদের ভালো স্কুলে ভর্তি করাতে পারবেন। এর বাইরে আরও অনেক প্রণোদনা আছে।

অপর এক কর্মকর্তা জানান, প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তারা অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মধ্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বা ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান। যারা উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে সরকারি কার্যক্রমের সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকেন।

কিন্তু কৃষি, চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ ও অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে বিশেষায়িত এসব ক্যাডারে কর্মকর্তাদেরকে তাদের চেয়ে জুনিয়র প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের অধীনে কাজ করতে হয়। এটা সুস্পষ্ট বৈষম্য, যা অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা মেনে নিতে পারেন না।

বিসিএস ইনফরমেশন অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এস এম গোলাম কিবরিয়া উদাহরণ দিয়ে বলেন, ১৩তম বিসিএসে চাকরিতে ঢোকা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা এক বছরে আগেই সরকারি চাকরির সর্বোচ্চ গ্রেড অর্থাৎ সচিব হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া শুরু করেছেন। একইসঙ্গে অর্থাৎ ১৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারের যোগ দেওয়া কর্মকর্তারা সর্বোচ্চ ৪র্থ গ্রেডে এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারে তৃতীয় গ্রেড পর্যন্ত পৌঁছেতে পেরেছেন।

বর্তমানে অবসরে থাকা গোলাম কিবরিয়া আরও বলেন, পদোন্নতিতে বৈষ্যম দূর করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তখন উনার জনপ্রশাসন উপদেষ্টা ছিলেন এইচ টি ইমাম। উনার নেতৃত্বে একাধিক বৈঠকও আমরা করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটার ধারাবাহিকতা থাকেনি।

চিকিৎসা শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক বায়েজিদ খুরশিদ রিয়াজ বলেন, 'একজন উপসচিব সুদমুক্ত গাড়ি ঋণ ও একজন চালকের বেতন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা পান। একজন অধ্যাপক এমন কিছু পান না।'

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দেশে যখন চিকিৎসকের অভাব, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, তখন মেডিকেল গ্র্যাজুয়েটরা অন্য চাকরি বেছে নিচ্ছেন, এটি উদ্বেগজনক।

'এটা দুঃখজনক যে তারা গ্রামে যায় সরকারি কর্মচারী হিসেবে, চিকিৎসক হিসেবে নয়।'

মন্তব্য জানতে পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে জানান, এ বিষয়ে তার কিছু বলার নেই। তিনি বলেন, 'কমিশন নিয়ম অনুযায়ী প্রার্থী বাছাইয়ের পর নিয়োগের সুপারিশ করে। এর বাইরে কোনো উদ্যোগ নিতে হলে সেটা সরকার নিতে পারে।'

Comments

The Daily Star  | English

Hopes run high as DU goes to vote today

The much-anticipated Ducsu and hall union elections are set to be held today amid a new wave of hope and expectations for what is being seen as a turning point for campus democracy after a six-year hiatus.

2h ago