‘এই পাখি- এতটুকু…’

দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারের ছাদবাগানে বাগানবিলাসের ডালে মুনিয়ার ঝাঁক। ছবি: মামুুনুর রশীদ/স্টার

পাথারিয়া পাহাড়ের কোলে বিস্ময়ের কুয়াশায় জেগে ওঠা এক নিসর্গসখা দ্বিজেন শর্মা জানিয়েছিলেন, ছেলেবেলায় স্থবির গাছেদের দেখে তার মনে বিস্ময় জাগেনি। বিস্ময় প্রথম জেগেছিল পাখি দেখে।

বাংলার নিসর্গের আরও অনেক অনুষঙ্গের মতো পাখির মায়ায় পড়া কবি জীবনানন্দও লিখেছেন, '…এই পাখি- এতটুকু- তবু সব শিখেছে সে- এ এক বিস্ময়'।

বলা হয়ে থাকে, প্রকৃতিতে প্রজাপতি ছাড়া আরেকটি 'উড়ন্ত সৌন্দর্য' হলো পাখি। দ্বিজেন শর্মা বলতেন, শিশুমনে পাখি যে পরিমাণ বিস্ময়ের উদ্রেক করে, এর সমতুল্য আর কিছুই নেই।

খুনসুটি। ছবি: স্টার

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বাংলাদেশে কমবেশি ৭২২ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। এগুলোর ভেতর অতি ক্ষুদ্র এক প্রজাতি মুনিয়া। বাংলাদেশে এই মুনিয়া আছে ছয় জাতের। এরা মূলত গ্রাসল্যান্ড বার্ড অর্থাৎ ঘাসবনের পাখি।

মুনিয়া সাধারণত ঘাসবনে বাসা বাঁধে। এদের বাসা বানানোর উপকরণ ঘাস-পাতা-ফুল। বিচরণ কাশবন, বালুময় শণবন, নদীতীরের আবাদি জমি ও কাঁটা ঝোপে। খাবার ঘাসের বীজ ও কচি পাতা, পোকামাকড়। এ প্রজাতির পাখির ঠোঁট বিবর্তিত হয়েছে ঘাসবীজ খাওয়ার জন্য

সেই মুনিয়াকেই যদি সবুজের স্নিগ্ধতা ঘুচে যাওয়া এই বৃক্ষ-ঘাসহীন ঊষর ঢাকা মহানগরের কোনো ছাদে দলে দলে উড়ে-ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়, তাহলে তো এ ঘটনাকে 'মহাবিস্ময়' বললেও অত্যুক্তি হবে না!

সম্প্রতি এমন দৃশ্য চোখে পড়ল ফার্মগেট-সংলগ্ন দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারের ছাদবাগানে।

খেয়াল করে দেখা গেল, এটি দেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি দেশি চাঁদিঠোঁট মুনিয়া বা Indian Silverbill। ধূসর ঠোঁট ও কালো লেজের এ পাখির দেহের দৈর্ঘ্য ১০ সেন্টিমিটার, ওজন ১২ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির সাদা কোমর, দেহের পেছনের অংশ, ডানাসহ পিঠ ফিকে ও মেটে বাদামি। লম্বা সুচালো লেজ কালচে। দেহতল সাদাটে। ঠোঁট ত্রিকোণাকার ও ধূসরাভ। পা, পায়ের পাতা ও নখর ধূসরাভ-পাটল রঙের। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারা অভিন্ন।

প্রিয় জায়গা। ছবি: স্টার

শুরুর বিস্ময় কাটিয়ে শহরের ছাদে ঘাসবনের এই পাখির আগমনের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বোঝা গেল, ডেইলি স্টার ভবনের এই ছাদবাগানে মুনিয়ার জন্য যথেষ্ট খাবারের মজুত আছে।

সুপরিসর এই ছাদে আছে দেশি-বিদেশি লতা-ঘাস ও গুল্মজাতীয় অনেক উদ্ভিদ। আরও আছে তুলসি, নয়নতারা, অপরাজিতা, বকুল, বাগানবিলাস, জবা, গোলাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ।

বাগানের তত্ত্বাবধায়ক গোলাম রব্বানী জানালেন, মুনিয়া এখান থেকে ঘাসের বীজ, তুলসি বীজ, নয়নতারার বীজ খুঁটে খায়। বিপদের আঁচ পেলে দ্রুত ঝোঁপঝাড়ের ভেতর লুকিয়ে পড়ে। এই ছাদটি মুনিয়াদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল।

ডেইলি স্টারের এই ছাদবাগানে ড্রাগন, ডালিম, আমড়া, পেয়ারা, লেবুসহ বিভিন্ন ফলের গাছও আছে। ফলে মুনিয়ার পাশাপাশি চড়াই, টুনটুনির মতো ছোট পাখি এবং ঘুঘু, টিয়া, কবুতর ও বুলবুলির মতো অপেক্ষাকৃত বড় পাখিদের আনাগোনাও বেশ চোখে পড়ে এখানে।

ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে। ছবি: স্টার

এছাড়া এই ছাদ ঘেঁষেই বাসা বেঁধেছে ভুবনচিলের কয়েকটি পরিবার। সবমিলিয়ে পাখিদের জন্য এই ছাদটি হয়ে উঠেছে একটি অভয়াশ্রমের মতো।

ফেরা যাক চাঁদিঠোঁট মুনিয়ার প্রসঙ্গে। এই পাখি বসবাসের জন্য নিরাপদ জায়গা পছন্দ করে। মানুষ কিংবা শিকারি পাখির উপস্থিতি টের পেলেই পালিয়ে যায়।

তাই এদের অগোচরে নিরাপদ দূরত্বে থেকে বেশ কয়েক বিকেলের পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা গেল, ছাদবাগানে এদের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা হলো বাগানবিলাসের ডাল, দেয়াল বেয়ে ঝুলে থাকা ওয়াল কিপারের ঝোপ ও ছাদের ওপর লাগানো বজ্র নিরোধক দণ্ডগুলো। এরা দলবদ্ধভাবে লতায়-পাতায় থাকতে পছন্দ করে। স্বভাবে চঞ্চল। নিজেদের ভেতরে খুনসুটিতে ব্যস্ত থাকে সবসময়। এরা আকারে এতই ছোট যে, চিপ চিপ ডাকে নিজেরা জানান না দিলে এদের অস্তিত্বই টের পাওয়া কঠিন।

মুনিয়াদের এসব কর্মকাণ্ড মনে করিয়ে দেয় জীবনানন্দের 'পাখি' শিরোনামের আরও কয়েকটি পঙ্‌ক্তি—'…তার মুখে স্বপ্ন সাহসের ভর/ব্যথা সে তো জানে নাই- বিচিত্র এ জীবনের 'পর/করেছে নির্ভর;/রোম-ঠোঁট-পালকের এই মুগ্ধ আড়ম্বর।'

Comments

The Daily Star  | English

14 arrested over attacks, clashes in Gopalganj

At least 14 people have been arrested so far in connection with yesterday’s attack on NCP rally and subsequent clashes with law enforcers

13m ago