গার্মেন্ট এলাকায় চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য

গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারে ৬ হাজারেরও বেশি পোশাক কারখানায় ৩২ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। ছবি: সংগৃহীত
গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারে ৬ হাজারেরও বেশি পোশাক কারখানায় ৩২ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। ছবি: সংগৃহীত

গত ২০ অক্টোবর গাজীপুরের মানিপুর বাজারের একটি পোশাক কারখানায় গিয়ে স্থানীয় চার বিএনপি নেতা এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন।

নাম না প্রকাশের শর্তে কারখানার মালিক দ্য ডেইলি স্টারকে অভিযোগে করে বলেন, 'তারা বলেছিল, সামনে নির্বাচন। তাই টাকা দরকার।'

কারখানা মালিক সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা দিতে চাইলে নেতারা তার কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন।

তিনি বলেন, 'আমি বাধ্য হয়েই পুরো টাকা দিয়েছি। থানায় অভিযোগ করলে যদি দল ক্ষিপ্ত হয়, পুলিশ কি আমাকে বাঁচাবে?'

তিনি জানান, আগেও এমন ঘটনায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযোগ করেছিলেন, কিন্তু কোনো সাড়া পাননি।

এ ধরনের ঘটনার উদাহরণ আরও আছে।  

গত ১৭ অক্টোবর গাজীপুর সিটির টেক কাঠোরা এলাকায় ২০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক এক স্থানীয় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রতিমাসে ৬৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

ওই ব্যবসায়ী রাজি না হওয়ায় তার প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই ঘটনার জেরে মালিকপক্ষ থেকে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে অভিযোগ দায়ের করা হয়।  

গত ২ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের শিবপুর এলাকায় চাহিদা অনুযায়ী চাঁদা না দেওয়ায় জনৈক ব্যবসায়ী সোহেল মিয়াকে এক ছাত্রদল নেতা মারধর করেন। এতে তার দুটি দাঁত ভেঙে যায় এবং ডান হাত স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যায় বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে।

গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারে ৬ হাজারেরও বেশি পোশাক কারখানায় ৩২ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেন।

এসব এলাকার ব্যবসায়ীরা বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পুরাতন চাঁদাবাজরা পালিয়ে গেলেও চাঁদাবাজি কমেনি।

দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ যে খাত থেকে আসে, সেই তৈরি পোশাক খাতে এখনও 'রাজনৈতিক আশ্রয়ে' চাঁদাবাজি অব্যাহত রয়েছে—এমন অভিযোগ জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

মালিকরা জানান, পোশাক তৈরির পর অতিরিক্ত কাপড়ের টুকরো বা 'ঝুট'-এর লাভজনক ব্যবসা এখন আবার আধিপত্যের লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

আগে এই ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে ছিল আওয়ামী লীগ নেতারা। এখন তা অনেকাংশে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের হাতে চলে এসেছে। বছরে প্রায় চার লাখ টন ঝুট উৎপন্ন হয়।

টঙ্গীর এক কারখানা ব্যবস্থাপক জানান, বাজারদর হিসাবে তার কারখানায় মাসে প্রায় ৫০ লাখ টাকা মূল্যমানের ঝুট উৎপাদন হতো। কিন্তু বাধ্য হয়ে তাকে ওই পণ্য অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জের এক ব্যবসায়ী বলেন, মাঝারি আকারের কারখানায় মাসে ২০–২২ লাখ টাকার ঝুট হয়। বাজারদর ৪০ টাকা হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক নেতারা কেজি প্রতি মাত্র ২–৪ টাকা দিয়ে সেই পণ্য নিয়ে যান। যার ফলে লোকসানে পড়েন ব্যবসায়ীরা।

সব মিলিয়ে বলা যায়, ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া একটি স্থায়ী আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই এই ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সহিংস সংঘাতও হচ্ছে।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে এ বছরের ৮ অক্টোবর পর্যন্ত গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারে ঝুট ব্যবসা নিয়ে অন্তত ১৫টি সংঘর্ষে ৩০ জন আহত হয়েছেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত এক বছরে বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে অন্তত ৬৫ নেতাকর্মী নিহত ও ২ হাজার ৯৬২ জন আহত হয়েছেন। এর অনেকগুলোই ঝুট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে।

চাঁদাবাজের চেহারা বদলেছে, চাঁদাবাজি অব্যাহত রয়েছে

কারখানার মালিকরা জানান, এখন চাঁদাবাজি আরও তৃণমূল পর্যায়ে নেমে এসেছে।

সাভারের এআর জিন্স প্রডিউসার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল কবির বলেন, 'আগে চাঁদাবাজি কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো। এখন হয় এলাকাভিত্তিক। আমরা ম্যানেজ করে চলি। আশায় আছি যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একসময় ভালো হবে।'

সাভারে আর্থিক লেনদেনের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকে এখন স্থানীয় বিএনপি নেতাদের হাতে চলে গেছে।

গাজীপুরে বিএনপির বিভিন্ন অংশ ককটেল, আগ্নেয়াস্ত্র ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে দাপট দেখায়; আর নারায়ণগঞ্জে ভয়ভীতি দেখানো হয় তুলনামূলক নীরবে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে 'কন্ট্রিবিউশন' চেয়ে চাপ সৃষ্টি করছেন।

সাভারে একটি কারখানার মালিক তাসকিন বলেন, 'এমনকি ঝুটও বাজারদামের অর্ধেকে বিক্রি করতে হয়। না দিতে চাইলে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। একদল গেছে, আরেক দল এসে বসেছে।'

তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে অন্যান্য ব্যবসায়ীরা বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব পাল্টালেও চাঁদাবাজি এখনো চলছে।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ স্বীকার করেছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে চাঁদাবাজি বেড়েছে।

তিনি গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা রাজনৈতিক সরকার না হওয়ায় কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারি না। চাঁদাবাজির হার ১ টাকা থেকে বেড়ে দেড় বা ২ টাকায় পৌঁছেছে।'

বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর এই ধরনের সমস্যা সাধারণত বাড়ে। 'এক বছর চেয়ে এখন পরিস্থিতি ভালো। এখনো এসব ঘটনা ঘটছে, তবে আগের মতো এতো বেশি না।'

ইনোভিশন কনসাল্টিং পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের ৫৬ দশমিক ৬ শতাংশ—যাদের বেশিরভাগ শহুরে তরুণ ও উচ্চ আয়ের শ্রেণির—মনে করেন, ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত ৬ মাসে চাঁদাবাজি বেড়েছে।

বিএনপির অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে যারা আত্মগোপনে ছিলেন, সেই তৃণমূল নেতারা সরকার পরিবর্তনের পর ঝুট ব্যবসা থেকে মুনাফা করার সুযোগ দেখছেন।

নারায়ণগঞ্জ বিএনপির সদস্যসচিব আবু আল ইউসুফ অভিযোগ করে বলেন, 'ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কিছু নেতা এখন বিএনপির কিছু সদস্যের সঙ্গে মিলে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে এবং ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। এতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।'

সবার শাস্তি হয় না

শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক গাজী জসিম উদ্দিন বলেন, 'আমরা এ ধরনের কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাইনি। কিছু মালিক ঝামেলা এড়াতে কোনো অভিযোগ করতে চান না। আমরা তাদের বলেছি, কোনো সমস্যা হলে যেন সরাসরি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।'

গত ১৮ সেপ্টেম্বর এক ফেসবুক পোস্টে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জানান, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও অসদাচরণের অভিযোগে দলের সাত হাজারের বেশি সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যাদের অনেককেই বহিষ্কার করা হয়েছে।

তবে, সব অভিযোগের পর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

মামলার এজাহার অনুযায়ী, গত ২৩ আগস্ট গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় ৫০ হাজার টাকা চাঁদা না পেয়ে এক স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা একটি কারখানার ড্রেনে ২০ ভ্যান ময়লা ফেলে দেন।

পরে তিনি ও তার সহযোগীরা কারখানার সহকারী মহাব্যবস্থাপককে মারধর করেন বলেও অভিযোগ আছে।

শ্রীপুর মডেল থানায় দায়ের করা মামলায় ওই স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা ও আরও চারজনের নাম উল্লেখ করা হয়, সঙ্গে অজ্ঞাত আসামি ২১ জন। এই ঘটনায় পুলিশ এখন পর্যন্ত একজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

অভিযোগকারী কারখানা এক কর্মকর্তা বলেন, 'এরা সবসময় রাজনৈতিক আশ্রয় থাকে। ওই স্বেচ্ছাসেবক দল নেতাকে এমপি পদপ্রত্যাশী এক স্থানীয় বিএনপি নেতা সমর্থন দেন। শুধুমাত্র সাবেক সেনা কর্মকর্তা হওয়ায় আমি টিকে আছি।'

দুই মাস কেটে গেলেও ওই স্বেচ্ছাসেবক দল নেতার বিরুদ্ধে দলীয় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দ্য ডেইলি স্টার চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি।

গাজীপুরের আরও আটটি কারখানা মালিক দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তারাও একই ধরনের হুমকির মুখে পড়েছেন, কিন্তু ভয়ে চুপ থাকছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, 'খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও তারেক রহমানের লন্ডননির্ভর নেতৃত্বের কারণে বিএনপির সাংগঠনিক শৃঙ্খলা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর ফলে নেতৃত্ব সংকট সৃষ্টি হয়েছে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, 'অনেকে মনে করেন, বিএনপিই এরপরে সরকার গঠন করবে। তাই ব্যবসায়ী ও পুলিশ কেউই তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের বিরোধে যেতে যায় না। এ কারণে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা বাধাহীনভাবে এসব কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।'

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু স্বীকার করেছেন, দলের কিছু সদস্য চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, 'আমি বলব না যে বিএনপির কেউ জড়িত না। কিন্তু, অনেক সময় অন্যের অপরাধও আমাদের ঘাড়ে চাপানো হয়। নির্বাচিত সরকার না থাকলে এ ধরনের ঘটনা চলতেই থাকবে। চাঁদাবাজি ও হুমকি দেওয়ার ঘটনায় দলীয় কেউ সম্পৃক্ত থাকলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় অনেককে আমরা বহিষ্কারও করেছি।'

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, 'যেখানই অনিয়মের সঙ্গে দলের কারও জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই দলের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দলের পক্ষ থেকে আমরা এসব ব্যাপারে সর্বোচ্চ হার্ড লাইনে।'

'এসব অনিয়মের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। আমরা ইতোপূর্বেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেছি, তারা যেন ব্যবস্থা নেয়,' যোগ করেন তিনি।

Comments