আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় চ্যালেঞ্জ: থানায় পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে জব্দ গাড়ি
ছয় বছর ধরে মামলা চলেছে। অবশেষে এ বছরের আগস্টের শুরুতে ওমান প্রবাসী মরিয়ম আক্তার নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি ফিরে পেতে কাফরুল থানায় আসেন। কিন্তু ততদিনে গাড়িটি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে।
২৩ আগস্ট মরিয়ম আদালতের অনুমতিপত্র নিয়ে থানায় যান। কিন্তু পুলিশ যখন গাড়িটি দেখায়, তিনি হতবাক হয়ে যান। গাড়িটি চ্যাপ্টা হয়ে গেছে, ভেতরের সব যন্ত্রাংশ খুলে নেওয়া হয়েছে। তার গাড়ির ওপর আরও তিনটি গাড়িও রাখা।
মরিয়ম বলেন, 'গাড়িটা চেনারই উপায় ছিল না। যদি জানতাম গাড়ির এই অবস্থা, এত কষ্ট করতাম না।'
মরিয়ম প্রায় এক মাস ধরে আদালত, বিআরটিএ ও আইনজীবীদের অফিসে ঘুরেছেন। সব কাগজপত্র করতে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে তার। কিন্তু যখন মেকানিকরা গাড়িটা দেখল, তারা জানিয়ে দিল এটা আর মেরামত করা যাবে না।
মরিয়ম বলেন, 'গাড়ির ভেতরটা পুরাই খালি ছিল। ধোলাইখালের মেকানিকরা বলল, অনেক আগেই সব যন্ত্রাংশ চুরি গেছে। তারা পরামর্শ দিল এটা ভাঙ্গারি হিসেবে বিক্রি করে দিতে। তাতে ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা দাম পাওয়া যেতে পারে।'
মরিয়ম ৯ বছর আগে এই সেকেন্ড-হ্যান্ড টয়োটা করোলাটি কিনেছিলেন ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। ২০১৯ সালে যখন তিনি বিদেশে ছিলেন, গাড়িটি ভাড়াটে এক ব্যক্তি অপহরণের চেষ্টায় ব্যবহার করেছিল। পরে সেটি প্রমাণ হিসেবে পুলিশ জব্দ করে থানায় রাখে।
মরিয়মের স্বামী মোহাম্মদ হানিফ বারবার পুলিশ ও আদালতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু সবাই বলেছিল শুধু মালিক নিজে এলে গাড়িটা ছাড়া যাবে। তাই মরিয়ম দেশে ফেরেন।
কাফরুল থানার স্টোর ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক আফজাল হোসেন বলেন, 'আমাদের হেফাজতে এখন ১৯টি প্রাইভেট কার, ৩০টি মোটরসাইকেল, তিনটি পিকআপ, একটি বাস ও তিনটি অটোরিকশা আছে। কিছু গাড়ি ২০০০ সাল থেকে পড়ে আছে।'
তিনি আরও জানান, প্রশাসনিক জটিলতার কারণে অনেক গাড়ি ফেরত দেওয়া যায় না। সেগুলো বছরের পর বছর খোলা আকাশের নিচে থাকে, রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হয়। ধুলা জমে, মশা জন্মায়, কিন্তু এগুলো রাখার অন্য কোনো জায়গা নেই।
গত ৭ অক্টোবর কাফরুল থানা পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, জায়গার অভাবে একটি গাড়ি আরেকটির ওপর তুলে রাখা হয়েছে। অনেক গাড়ি এতে করে চাপা পড়ে ভেঙে গেছে। অনেকগুলোর টায়ার, জানালা কিংবা বডি নেই।
রাজধানীর প্রায় ৫০টি থানায় একই অবস্থা। অপরাধ বা ট্রাফিক মামলার জব্দ গাড়িগুলো বছরের পর বছর এমনভাবেই পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে।
শাহ আলী থানার উপ-পরিদর্শক আরিফুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের থানায় সাতটি গাড়ি আছে। এর মধ্যে চারটি পুরোপুরি ভেঙে গেছে। তিনজন মালিক কখনও কখনও আসেন, কিন্তু সব কাগজপত্র না থাকায় নিয়ে যেতে পারেন না।'
জায়গার অভাবে কিছু গাড়ি ফুটপাথে রাখা হয়েছে। গত ৮ অক্টোবর শাহ আলী থানায় গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার ওপরও মোটরসাইকেল ও গাড়ি ফেলে রাখা।
থানার ওসি গোলাম আজম বলেন, 'থানাটা ছোট। তাই কিছু গাড়ি বাইরে রাস্তায় রাখা হয়েছে। নষ্ট গাড়িগুলোর পাহারার মতো পর্যাপ্ত জনবলও নেই।'
স্থানীয়রা জানান, এই পরিত্যক্ত গাড়িগুলোর আশপাশে চোর ও ভবঘুরে শিশুরা ঘোরাফেরা করে। রাতে কেউ কেউ এসে যন্ত্রাংশ খুলে নেয়। কেউ কেউ গাড়ির ভেতর ঘুমায় বলেও জানান এক বাসিন্দা। ফলে এই গাড়িগুলো অনেক জায়গায় জনদুর্ভোগ ও মশার প্রজননস্থলে পরিণত হয়েছে।
বানানী থানার সামনে প্রায় ৩৮টি গাড়ি, কয়েকটি মোটরবাইক ও একটি পিকআপ সেখানকার পাঁচটি রাস্তার জায়গা দখল করে আছে। থানার সামনের ২০ ফুট চওড়া রাস্তায় দুই সারিতে পরিত্যক্ত গাড়ি রাখা, ফলে প্রতিদিন যানজট হয়।
১০ অক্টোবর পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, পথচারী ও চালকরা বিরক্ত। এক পথচারী বলেন, 'পুলিশ এগুলো সরায় না কেন? রাস্তার অর্ধেক ব্লক হয়ে আছে।'
ওই এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহিম জানান, সন্ধ্যায় যান চলাচল বাড়লে ভোগান্তি আরও বাড়ে।
বানানী থানার ওসি রাসেল সরওয়ার বলেন, 'এই গাড়িগুলো আদালতের আলামত। আদালতের আদেশ ছাড়া সরানো যায় না। এটা আমাদের জন্যও বোঝা। ট্রাফিক কর্তৃপক্ষও বলে সরাতে, কিন্তু পারি না।'
তিনি আরও বলেন, 'গত ১৪ মাসে কোনো মালিক বৈধ আদালতের কাগজপত্র নিয়ে গাড়ি নিতে আসেননি। ৯৯৯ হটলাইন থেকেও ফোন আসে, এই গাড়িগুলো সরাতে বলা হয়। এলাকার মানুষও অভিযোগ করে, কিন্তু আদালতের আদেশ ছাড়া আমরা কিছু করতে পারি না।'
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক-প্রশাসন ও পরিকল্পনা) আনিসুর রহমান বলেন, 'আমাদের কোনো স্থায়ী ইম্পাউন্ড লট বা ডাম্পিং স্টেশন নেই। তাই গাড়িগুলো থানার ভেতর বা রাস্তার পাশে রাখতে হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা চারটি অস্থায়ী জায়গা ব্যবহার করছি—শাহবাগ, বসিলা, পোস্তগোলা ও উত্তরা পুলিশ লাইন। স্থায়ী চারটি ডাম্পিং স্টেশনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। পেলে এই সমস্যা কমবে।'
শাহবাগের ডাম্পিং গ্রাউন্ডে গিয়ে দেখা যায়, এই জায়গার অবস্থা বেশ করুণ। এখানে বিভিন্ন বিভাগে জব্দ করা গাড়ি রাখা হয়। কিন্তু কোনো দেয়াল নেই, পানি আর কাদায় ভরে আছে জায়গাটা। মানুষজন সহজেই ঢুকে পড়ে। কেউ কেউ গাড়ির ব্যাটারি, টায়ার বা যন্ত্রাংশ খুলে নেয়। গেটে একজন কনস্টেবল বসে থাকেন, তিনি প্রায়ই ব্যস্ত থাকেন অন্য কাজে।
কনস্টেবল মোহাম্মদ রাকিব বলেন, 'এখানে প্রায় ১৫০টি অটোরিকশা, কয়েকটি বাস ও মোটরসাইকেল আছে। আমরা তিন শিফটে কাজ করি, কিন্তু প্রতি শিফটে মাত্র একজন কনস্টেবল থাকেন। ভেতরে নিরাপত্তা নেই। কেউ এসে বলে গাড়িটা তার, তারপর যন্ত্রাংশ খুলে নেয়। আমরা আটকাতে পারি না, জনবল নেই।'
৮ অক্টোবরের পরিদর্শনে গেলে দেখা যায়, ৩০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি একটি অটোরিকশা থেকে টায়ার খুলছেন। তিনি বলেন তার নাম নূর মোহাম্মদ। তিনি দাবি করেন, গাড়িটা তারই, ট্রাফিক পুলিশ জব্দ করেছিল। জরিমানা দিতে এসে দেখেন টায়ার নেই, তাই যা বাকি আছে তা নিয়ে যাচ্ছেন।
আরেকজনও এসেছেন, নাম আল আমিন। তিনিও নিজের গাড়ির ব্যাটারি ও সিট খুলে নিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, 'আমরা না নিলে এগুলো চুরি হয়ে যাবে।'
এই বিষয়ে জানতে চাইলে কনস্টেবল রাকিব বলেন, 'আমাদের বলা আছে কেউ এলে কাগজপত্র দেখে ছাড় দিতে। তার বাইরে কিছু করার ক্ষমতা নেই।'
ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে যন্ত্রাংশ চুরির বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার আনিসুর বলেন, 'আমরা চেষ্টা করব চারপাশে দেয়াল ও আলোর ব্যবস্থা করতে, যেন এসব ঘটনা বন্ধ হয়।'
এই সমস্যা মূলত কাঠামোগত—জায়গার অভাব, জনবল সংকট ও প্রশাসনিক কারণে দেরি।
পুরো ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়েছে স্বীকার করে নিয়ে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, 'নির্দিষ্ট ডাম্পিং গ্রাউন্ড না থাকায় মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত জব্দ গাড়িগুলো থানায় পড়ে থাকে। আদালতের আদেশ ছাড়া এগুলো মুক্ত বা নিলাম দেওয়া যায় না।'
তিনি আরও বলেন, 'নিলামের সুযোগ আছে, কিন্তু দীর্ঘসূত্রতায় তা-ও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এদিকে গাড়িগুলো নষ্ট হয়, যন্ত্রাংশ চুরি যায়, আর মূল্যও কমে যায়।'
জব্দ গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরি ও ক্ষতির বিষয়ে নিয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (লজিস্টিক, ফাইন্যান্স ও প্রোকিউরমেন্ট) হাসান মো. শওকত আলী বলেন, 'আমাদের সম্পদ সীমিত'। এর বেশি তিনি আর কিছু বলতে চাননি।
অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মো. শামসুদ্দোহা সুমন বলেন, 'আদালতেরও জব্দ গাড়ি রাখার জায়গা নেই। বিচার শেষ হলে আদালতের আদেশে পুলিশ সেগুলো সরাতে পারে।'
তবে পুলিশ চাইলে সময়মতো আদালতে রিপোর্ট জমা দিয়ে অনেক গাড়ি আগেই ছেড়ে দিতে পারে বলে জানান সুমন।
মরিয়ম আক্তারের দুর্ভোগ যেন পুরো সমস্যারই একটি প্রতিচ্ছবি। তিনি বলেন, 'আমার সাড়ে ৭ লাখ টাকার গাড়ি শেষ হয়ে গেছে। কেউ এর দায় নিচ্ছে না। ক্ষতিপূরণ নেই, জবাবদিহিতাও নেই।'


Comments