৫ বছরেও বিল্ডিং তদারকি কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়নি
বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) সংশোধন করে গেজেট প্রকাশের পাঁচ বছর পার হয়েছে। কিন্তু এটি বাস্তবায়নের জন্য যে তদারকি কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা ছিল, তা এখনও হয়নি। ফলে দেশের অনেক নগর এলাকায় ভবন নির্মাণ কার্যত নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে।
বিএনবিসি-২০২০ অনুযায়ী, ভবনের নিরাপত্তা, অগ্নি-নিরাপত্তা, ভূমিকম্প সহনশীলতা, মানসম্মত নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার এবং পেশাগত জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিবিআরএ) গঠনের বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু এখনও সেই তদারকি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়নি।
এর বদলে আগের সরকার জেলা পর্যায়ে বিল্ডিং কমিটির প্রধান হিসেবে জেলা প্রশাসকদের দায়িত্ব দেয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, কোডের নিয়মের সঙ্গে এর মিল ছিল না এবং বাস্তবেও কার্যকর হয়নি।
বর্তমান সরকার একটি অন্তর্বর্তী কমিটি গঠন করেছে। এতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব, রাজউক চেয়ারম্যান, পিডব্লিউডির প্রধান প্রকৌশলী এবং অন্যান্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরা আছেন। তারা বিবিআরএ গঠনের আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করেছেন।
সম্প্রতি ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকা, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জে কমপক্ষে ১০ জন মারা যান, শতাধিক মানুষ আহত হন এবং রাজউক এলাকার প্রায় ৩০০ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে—কার্যকর তদারকি ছাড়া দেশ কতটা ঝুঁকিতে আছে।
বিএনবিসি সংশোধন কমিটির সদস্য নগর পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ আবু সাদেক বলেন, 'কোড ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে এটি "জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থা" হিসেবে কাজ করতে পারে। এতে রয়েছে অগ্নি-নিরাপত্তা, ভূমিকম্প সহনশীলতা ও বৈদ্যুতিক ত্রুটি রোধের নিয়ম—যা শহরের অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণগুলো সমাধান করে।'
তিনি বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও পৌরসভায় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থাকলেও উপজেলা ও গ্রামীণ এলাকায় তদারকির কোনো শক্তিশালী কার্যকর কর্তৃপক্ষ নেই।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারীর মতে, বড় শহরগুলোতেও কোডের বাস্তবায়ন সীমিত। আর অন্যান্য এলাকায় তা "প্রায় নেই" বললেই চলে।
রাজউকের হিসাব আরও উদ্বেগজনক। ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে এবং মারা যেতে পারে প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ। সরু গলি ও শতবর্ষী ভবনের কারণে পুরান ঢাকা সবচেয়ে ঝুঁকিতে।
চট্টগ্রামে ৩ লাখ ৮০ হাজারের বেশি ভবনের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটি। ৭ দশমিক ৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে বন্দর, রিফাইনারি সহ বড় স্থাপনাগুলো ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
সিলেট সক্রিয় ডাউকি ফল্টের ওপর হওয়ায় সেখানে সাম্প্রতিক সময়ে ছোট ছোট ভূমিকম্প বাড়ছে। এখানকার ৭০ শতাংশের বেশি ভবনই ভূমিকম্প সহনশীল নকশা ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছে।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, তারা এখন বিবিআরএ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় নথি তৈরি ও বিভিন্ন পক্ষের মতামত নেওয়া শুরু করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ও সচিব মো. নাজরুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা সাড়া দেননি।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, অন্তর্বর্তী কমিটি প্রস্তুতিমূলক কাজ করছে। তারা আশা করছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই বিবিআরএ গঠন করা সম্ভব হবে।
তবে আবু সাদেক বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে বিষয়টি অগ্রাধিকার নাও পেতে পারে।
বিএনবিসি-২০২০ অনুযায়ী, যেসব এলাকায় সিটি করপোরেশন বা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নেই, সেখানে জেলা পর্যায়ে পিডব্লিউডির নির্বাহী প্রকৌশলী "বিল্ডিং অফিসিয়াল" হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
তবে ২০২২ সালে আগের সরকার ডিসি-নেতৃত্বাধীন কমিটি গঠন করে এই বিধানকে পাশ কাটায়। এতে প্রশ্ন ওঠে—শতাধিক কমিটির দায়িত্বে থাকা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা না থাকা একজন কর্মকর্তা কীভাবে ভবন নিরাপত্তা তদারকি করবেন?
সেন্টার ফর হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চের প্রধান আবু সাদেক বলেন, এই ব্যবস্থা দেশের বিল্ডিং কোড বাস্তবায়নকে "প্রায় পঙ্গু" করে দিয়েছে।
তার মতে, জেলা পর্যায়ে বিবিআরএ-র নেতৃত্ব দেওয়া উচিত পিডব্লিউডির নির্বাহী প্রকৌশলীদের এবং উপজেলায় সদস্যসচিব হওয়া উচিত উপজেলা প্রকৌশলীর। কারণ তারাই নির্মাণ তদারকিতে দক্ষ।
তিনি আরও বলেন, জনস্বাস্থ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রকৌশলীদের অন্তর্ভুক্ত করলে তদারকি আরও শক্তিশালী হবে।
বুয়েটের অধ্যাপক মুনাজ আহমেদ নূর বলেন, বিএনবিসিতে সম্পূর্ণ একটি নিরাপত্তা প্রক্রিয়া উল্লেখ আছে। স্থাপত্য, কাঠামো, বৈদ্যুতিক, যান্ত্রিক ও অগ্নি-নিরাপত্তার নকশা অনুমোদন করতে হবে। যেসব সংস্থার দক্ষতা নেই, তাদের তৃতীয় পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞ নিতে হবে। নির্মাণকাজ ঠিকভাবে হচ্ছে কি না, তা নজরদারি করতে হবে।
তিনি বলেন, এসব বাধ্যতামূলক ধাপের কোনোটিই বাংলাদেশে ঠিকভাবে মানা হয় না। তার মতে, ভূমি-ব্যবহারের নীতিমালাও জরুরি এবং বিবিআরএ-কে প্রকৃত ক্ষমতা দিতে হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, বিবিআরএ দ্রুত গড়া প্রয়োজন। ভূমিকম্প প্রস্তুতি হতে হবে সারাদেশে, মাটি-ভিত্তিক বিশ্লেষণ ও মাইক্রো-জোনিং অনুযায়ী। কী ধরনের এলাকায় নির্মাণ নিরাপদ হবে—তা এভাবেই নির্ধারণ করা সম্ভব।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের একটি সমন্বিত ভৌত পরিকল্পনা দরকার। ভূমিকম্প ঝুঁকি, ভূপ্রকৃতি ও ভূতাত্ত্বিক অবস্থা বিবেচনায় উন্নয়ন করতে হবে। না হলে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে।
এদিকে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস গত বৃহস্পতিবার নির্দেশ দিয়েছেন—দেশের সব ভবন অনুমোদন ও নির্মাণ তদারকির জন্য আলাদা একটি জাতীয় সংস্থা গঠনের সম্ভাবনা যাচাই করতে।
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন করা যায়, যা দেশের সব স্থাপনা ও নির্মাণ কাজের অনুমোদন দেবে।


Comments