বিশ্বের বিপজ্জনক ১০ রাস্তা

বলিভিয়ার লস ইউংগাস অঞ্চলে বৃষ্টির মাঝেই একটি গাড়িকে গভীর খাদধার দিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। ইউংগাস হাইওয়ে ‘ডেথ রোড’ নামে পরিচিত। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক রাস্তাগুলোর অন্যতম একটি। ছবি: সংগৃহীত

একবার ভাবুন তো, আপনি একটি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন। সেই পাথুরে রাস্তাটি খুব সরু, হঠাৎ পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেছে, দুই পাশে কোনো নিরাপত্তা দেওয়াল নেই—সামান্য ভুল করলেই নিচে পড়তে হবে। আর নিচে আছে গভীর গিরিখাদ! মানে সামান্য ভুল করলেই মৃত্যুর ঝুঁকি।

হ্যাঁ পাঠক, বিশ্বে এমন অনেক বিপজ্জনক রাস্তা রয়েছে। তেমন দশটি রাস্তার সন্ধান থাকছে এই লেখাতে। লেখাটি বিবিসি সায়েন্স ফোকাস ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন অবলম্বনে লেখা হয়েছে।

ভারতের কেলং কিশত্বর। ছবি: সংগৃহীত

কেলং কিশত্বর, ভারত

২৩৫ কিমি দীর্ঘ মাটির রাস্তাটি বিপজ্জনক পর্বতমালার মধ্য দিয়ে ভারতের কেলং থেকে কিশত্বর পর্যন্ত অবস্থিত। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, রাস্তাটি দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েক হাজার মিটার নিচের উপত্যাকায় পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। আবার কোনো সেফটি ব্যারিয়ার নেই। এর সঙ্গে যেকোনো মুহূর্তে নতুন বিপদ ডেকে আনতে পারে ভূমিধস। এছাড়া এখানের আবহাওয়া বেশ পরিবর্তনশীল। সবমিলিয়ে এটি ভারতের সবচেয়ে বিপজ্জনক রাস্তাগুলোর একটি।

এই রাস্তার একটি অংশ 'ক্লিফ হ্যাংগার' নামে পরিচিত। এই অংশটি অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং খুব কাছে গেলে ভেঙে পড়ার ঝুঁকিও আছে।

সার্বিয়ার ইবারস্কা মাগিস্ট্রালা। ছবি: সংগৃহীত

ইবারস্কা মাগিস্ট্রালা, সার্বিয়া

স্থানীয়দের কাছে এই রাস্তাটি 'ব্ল্যাক হাইওয়ে' নামে পরিচিত। কেউ কেউ স্টেট রোড-২২ বা ইবার হাইওয়ে বলেও ডাকেন। এটি ইউরোপের সবচেয়ে বিপজ্জনক রাস্তাগুলোর একটি এবং সার্বিয়ার অন্যতম ব্যস্ত সড়ক। এই হাইওয়ে বেলগ্রেডের সঙ্গে সার্বিয়ার অন্যান্য বড় শহরকে যুক্ত করেছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেও সংযোগ আছে, যেমন মন্টেনিগ্রো।

দীর্ঘ এই রাস্তার বাঁকগুলো সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং এখানে দুর্ঘটনার হার অনেক বেশি। বিশেষ করে রাতের বেলা দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। তবে অধিকাংশ দুর্ঘটনার কারণ, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো অথবা মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো।

রোমানিয়ার ট্রান্সফাগারাশান হাইওয়ে। ছবি: সংগৃহীত

ট্রান্সফাগারাশান, রোমানিয়া

ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে রোমানিয়ার হাইওয়েগুলোর মান কিছুটা দুর্বল। দেশটির সবচেয়ে বিখ্যাত ও বিপজ্জনক রাস্তা হলো ট্রান্সফাগারাশান হাইওয়ে। ঘূর্ণায়মান পর্বতমালার রাস্তাটি কোথাও কোথাও দুই হাজার মিটার উঁচুতে পৌঁছেছে এবং এর দৈর্ঘ্য ১৫০ কিলোমিটার। রাস্তার মধ্যে আছে চুলের কাটার মতো বাঁক, সুড়ঙ্গ এবং আকস্মিক উচ্চতার পরিবর্তন। সবমিলিয়ে এখানে গাড়ি চালানো বেশি কঠিন।

আরেকটি বড়ো ঝুঁকি হলো রাস্তার মাঝখানে বড় বড় ভেড়ার দল। কারণ স্থানীয়রা চারণভূমিতে ভেড়া নিয়ে যেতে এই রাস্তা ব্যবহার করেন।

নিউজিল্যান্ডের স্কিপার্স ক্যানিয়ন রোড। ছবি: সংগৃহীত

স্কিপার্স ক্যানিয়ন রোড, নিউজিল্যান্ড

স্কিপার্স ক্যানিয়ন নিউজিল্যান্ডের কুইন্সটাউনে অবস্থিত। এটি মূলত একটি গিরিখাত। ১৮৬২ সালে এই এলাকায় স্বর্ণ পাওয়া গেলে গিরিখাতের মধ্য দিয়ে একটি রাস্তা বানানোর প্রয়োজন হয়। পরে হাতে তৈরি সরঞ্জাম ও বিস্ফোরক ব্যবহার করে পাহাড়ি পাথর খুঁড়ে এটি তৈরি করা হয়। এখানকার পাথরগুলো একটু আলাদা ধরনের, বৃষ্টি হলে অত্যন্ত পিচ্ছিল হয়ে যায়। আবার বেশি শুকনো হলে ভেঙে যেতে পারে।

রাস্তাটিতে চুলের কাটার মতো অসংখ্য বাঁক রয়েছে এবং ২২ কিমি দীর্ঘ রাস্তাটির বেশিরভাগ একদিকে চলাচলের জন্য উপযোগী। এই রাস্তা এতটাই বিপজ্জনক যে, এখানে গাড়ির বিমা কার্যকর হয় না।

অবশ্য ওই এলাকায় স্বর্ণ ফুরিয়ে এলে এই রাস্তার গুরুত্ব কমে যায়। তবে ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের কারণে এটি আজও জনপ্রিয় পর্যটক কেন্দ্র।

যুক্তরাষ্ট্রের জেমস ড্যালটন হাইওয়ে। ছবি: সংগৃহীত

জেমস ড্যালটন হাইওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র

টেলিভিশন শো 'আইস রোড ট্রাকার্স' দিয়ে জেমস ড্যালটন হাইওয়ে (হল রোড নামেও পরিচিত) খ্যাতি পেয়েছে। দীর্ঘ এই রাস্তাটি ফেয়ারব্যাঙ্কস শহরকে আর্কটিক সার্কেলের উত্তরাঞ্চলের ডেডহর্স কমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত করেছে।

৬৬৬ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে আলাস্কার একজন ইঞ্জিনিয়ারের নামে। এটি তেলক্ষেত্রের কর্মীদের কাছে জ্বালানি ও দরকারি জিনিস পৌঁছে দেওয়ার প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দীর্ঘ রাস্তারটির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পাকা, বাকি অংশে নুড়ি ও পাথর ফেলে রাখা।

এই রাস্তার প্রধান বিপদ হলো বরফ ও তুষার। এছাড়া, এখানে মেরু ভালুকের উপস্থিতি ঝুঁকির পরিমাণ আরও বাড়িয়েছে।

ভারতের জজিলা পাস রাস্তা। ছবি: সংগৃহীত

জজিলা পাস, ভারত

জজিলা পাস লাদাখ অঞ্চলকে কাশ্মীর উপত্যকার সঙ্গে সংযুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্তা। হিমালয়ের উঁচুতে অবস্থিত রাস্তাটি বরফ ও তুষারের কারণে মাসের পর মাস বন্ধ থাকে। মাত্র একটি মোটরযান চলার মতো চওড়া জজিলা পাস। কোনো সেফটি ব্যারিয়ার না থাকায় নিচের খাদে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে।

রাস্তার বড় একটি অংশের জন্য নতুন সুড়ঙ্গ নির্মাণ করা হচ্ছে। যেন শীতের প্রভাব থেকে রাস্তাটিকে রক্ষা করা যায় এবং সারাবছর খোলা রাখা যায়। তবে তা কতটুকু সম্ভব হবে এখনই বলা যাচ্ছে না।

পাকিস্তানের ফেয়ারি মিডোজ রোড। ছবি: সংগৃহীত

ফেয়ারি মিডোজ রোড, পাকিস্তান

ফেয়ারি মিডোজ রোড পাকিস্তানের উঁচু পর্বতমালার মধ্য দিয়ে চলে গেছে। এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার মিটারের বেশি। আর রাস্তার প্রস্থ এত কম যে, মাত্র একটি গাড়ি চলতে পারে। আবার নিচের উপত্যকায় পড়ার ঝুঁকি ঠেকানোর জন্য কোনো সেফটি ব্যারিয়ার নেই এবং এটি প্রায়ই ঘটে।

এই ১৬ কিমি দীর্ঘ রাস্তা কারাকোরাম হাইওয়েকে ফেয়ারি মেডোজ ন্যাশনাল পার্কের ছোট গ্রাম তাতোর সঙ্গে সংযুক্ত করেভে। বিপজ্জনক হওয়ায় কেবল স্থানীয়রা এই রাস্তা ব্যবহার করে।

বলিভিয়ার ইউংগাস হাইওয়ে। ছবি: সংগৃহীত

ইউংগাস রোড, বলিভিয়া

বলিভিয়ার উত্তর ইউংগাস রোড বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক রাস্তাগুলোর একটি। এটি 'ডেথ রোড' নামেও পরিচিত। এই রাস্তার ৬৪ কিমি দীর্ঘ অংশ লা পাজ শহরকে ইউংগাস অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এক সময়ে এখানে প্রতি বছর ২০০ থেকে ৩০০ মানুষের মৃত্যু হতো। তবে এর আশেপাশে নতুন একটি নিরাপদ হাইওয়ে তৈরি হওয়ায় সবাই এখন রাস্তাটি এড়িয়ে চলে।

রাস্তাটি পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে। এর প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো কুয়াশা ও বৃষ্টি। কুয়াশা ও বৃষ্টির কারণে রাস্তার সংকীর্ণ বাঁক স্পষ্টভাবে দেখা যায় না।

চীনের সিচুয়ান-তিব্বত হাইওয়ে। ছবি: সংগৃহীত

সিচুয়ান-তিব্বত হাইওয়ে, চীন

সিচুয়ান-তিব্বত হাইওয়ে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু রাস্তার একটি। এটি অত্যন্ত ব্যস্ত রাস্তা। প্রায়ই ট্রাফিক জ্যাম থাকে এবং রাস্তা পার দীর্ঘ সময় লাগে। পুরো হাইওয়ে পার হতে কখনো কখনো ১৫ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

তুরস্কের বেয়বুর্ত ডি৯১৫ রাস্তা। ছবি: সংগৃহীত

বেয়বুর্ত ডি৯১৫, তুরস্ক

ডি৯১৫ রাস্তাটি বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রাস্তাগুলোর একটি। এতে অসংখ্য চুলের কাটার বাঁক এবং পাহাড়ি গভীর খাদ রয়েছে। এই রাস্তাটি উত্তরের ব্ল্যাক সি উপকূলকে বাইবুর্ত শহরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এটি একসময় প্রাচীন সিল্ক রোডের অংশ ছিল। স্থানীয়দের চলাচলের জন্য রাস্তাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে খাড়া পাথর, খারাপ আবহাওয়াসহ অন্যান্য বিপদের কারণে এই রাস্তাটি নিরাপদে পাড়ি দিতে অত্যন্ত সতর্কতা ও ধৈর্য প্রয়োজন।

Comments

The Daily Star  | English

The unhealed wounds of 1971: Bangladesh's unfinished liberation

The 1971 Bangladesh Liberation War was not merely a military conflict; it was a civilisational rupture that tore through the social fabric of an entire nation, leaving scars that have never properly healed.

1h ago