কাশ্মীর সংঘাত এবং ‘বয়ানের যুদ্ধ’

ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগরে ডাল লেকে পানিতে ভাসমান হাউসবোট। ছবি: রয়টার্স

ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, আঘাত-পাল্টা আঘাত, সীমান্তে সাইরেনের দামামা, অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান রাফালের পতন, সব মিলিয়ে গত সপ্তাহে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা সারা বিশ্বের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের এই সংঘাত পুরোপুরি যুদ্ধে গিয়ে ঠেকতে পারে বলে উদ্বেগ বাড়ে।

তবে শনিবার মার্কিন প্রেসিডেন্টের সত্য বচনে (ট্রুথ বার্তায়) দুই দেশের অস্ত্রবিরতির খবরে স্বস্তি নেমে আসে। তবে এই স্বস্তি 'অস্বস্তিকর' সন্দেহ নেই, খচখচে স্বস্তি। আদৌ কি দুই দেশ যুদ্ধ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে নাকি আবারও ভূস্বর্গকে ভাগ করা নিন্ত্রয়ণরেখা জ্বলে উঠবে গোলার আগুনে।

যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও সেই রাতে কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণরেখার উভয় পাশে গোলাগুলির খবর আসে। শ্রীনগর, জম্মু ও অনন্তনাগে ড্রোন এবং গুলির ঘটনা ঘটে, যার জেরে শ্রীনগরে ব্ল্যাকআউট করতে হয়। এমনকি রাজস্থান ও গুজরাট সীমান্ত থেকেও গোলাগুলির খবর আসে। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের গ্রামগুলো থেকেও ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে।

এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন দেখা দেয়, দুই দেশ যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতির কথা বললেও এই নাজুক সমঝোতা টিকবে কিনা। যদি এবারের যুদ্ধবিরতি টিকে যায়ও, তবে আগামী দিনগুলোতে এক নতুন ধরনের লড়াই শুরু হতে পারে – যা হবে আখ্যান বা 'বয়ানের যুদ্ধ'।

গত ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ পর্যটককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় তেতে ওঠে দুই দেশের পরিস্থিতি। হামলাকারীরা পাকিস্তানের মদদপুষ্ট ছিল দাবি করে ভারত, অন্যদিকে এমন দাবি সরাসরি নাকচ করে দেয় পাকিস্তান। এরপরই শুরু হয় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, সেসব নাকচ আর পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। ওই ঘটনার ১৬ দিন পর পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারত। এর জবাবে দুই দিন পর ভারতে পাল্টা হামলা করে পাকিস্তান।

ভারতের 'অপারেশন সিঁদুর' আর পাকিস্তানের পাল্টা 'বুনইয়ান-উন-মারসুস' অভিযানের পর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে সীমান্ত পরিস্থিতি গেল রোববার রাতে 'শান্তিপূর্ণ' ছিল, বলছে ভারতের সেনাবাহিনী। কোনো ধরনের গোলাগুলি হয়নি।

তবে দুই দেশই যুদ্ধবিরতিকে নিজেদের বিজয় হিসেবে দাবি করেছে, যার ফলে দুই দেশের সীমান্তজুড়েই জাতীয়তাবাদী চেতনা আরও বেড়েছে। যেমনটা বিজয়ের হাজারো দাবিদার, পরাজয় স্বীকার করার কেউ নেই!

জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিকে 'পাকিস্তানের ঐতিহাসিক বিজয়' বলে দাবি করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ।

এদিন পাকিস্তানি সেনাদের ফুল ছিটিয়ে বরণ করা হয় এবং প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ ১১ মে-কে ভারতের সাম্প্রতিক আগ্রাসনের জবাবে 'সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকার স্বীকৃতি দিবস' হিসেবে ঘোষণা করেন।

অন্যদিকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে 'পাকিস্তান স্যারেন্ডার্ড' শিরোনামে খবর প্রচারিত হতে থাকে। রোববার ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং দাবি করেন, ভারতীয় সেনাদের গর্জন রাওয়ালপিন্ডি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে (পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদরদপ্তর)। তার এই মন্তব্য পাকিস্তানের নূর খান বিমানঘাঁটিতে ভারতের মিসাইল হামলার প্রসঙ্গে।

এছাড়াও অপারেশন সিঁদুর কেবল সামরিক অভিযান নয় এটি ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক আর কৌশলগত দৃঢ়তার প্রতীক বলেও জানান দিতে ভোলেননি।
 
অন্যদিকে যুদ্ধবিরতির খবর আসার পরপরই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেন, পাকিস্তান সবসময়ই এ অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য কাজ করে এসেছে, আর এটি করতে গিয়ে তারা কখনোই নিজেদের ভৌগোলিক অখণ্ডতা নিয়ে আপস করেনি।

পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যম ডন-এ বিশ্লেষক বাকির সাজ্জাদ যুদ্ধবিরতিকে পাকিস্তানের 'পরিকল্পিত বিজয়' হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, এর মাধ্যমে পাকিস্তান অনেক বেশি শক্তিশালী ভারতের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব এবং কূটনৈতিক বয়ান প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করেছে।

রোববার দুই দেশ তাদের অভিযানের তথ্য প্রকাশ করেছে। তবে যার যার বয়ানে। 

এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে ভারতের সামরিক মুখপাত্র জানান, সীমান্তে পাকিস্তানের গুলিতে পাঁচ সেনা নিহত হয়েছে। পাশাপাশি তাদের দাবি নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর গোলাগুলিতে পাকিস্তানের প্রায় ৪০ সেনা নিহত হয়েছে এবং পাকিস্তানে অবস্থানরত ১০০ সন্ত্রাসীকে হত্যা করা হয়েছে। ভারতের দাবি তারা কয়েকটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানায়নি।

অন্যদিকে গত বুধবারের সংঘাতে পাকিস্তান বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধবিমান রাফালসহ ভারতের অন্তত তিনটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিতের যে দাবি করেছে, বিশেষজ্ঞরা ধ্বংসাবশেষ বিশ্লেষণ করে সেই দাবির সত্যতা পেয়েছে। এ বিষয়ে অবশ্য ভারতের বক্তব্য, 'যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি হয়েই থাকে' এবং তারা নিশ্চিত করেছে যে তাদের সব পাইলট নিরাপদে ফিরে এসেছে।

সবশেষ গতকাল অস্ত্রবিরতির পর জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রথম ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানান, তারা তাদের সামরিক কার্যক্রম থামিয়ে রেখেছেন এবং আগামী দিনগুলোতে পাকিস্তান কী পদক্ষেপ নেয় সেটিও তারা খেয়াল রাখছেন। বলেন সন্ত্রাস ও আলোচনা একসঙ্গে চলতে পারে না, সন্ত্রাস ও বাণিজ্য একসঙ্গে চলতে পারে না, আর পানি এবং রক্তও একসঙ্গে বইতে পারে না। ভারত তার নীতি অনুযায়ী সন্ত্রাসবাদের জবাব দেবে এবং যে কোনো ধরনের পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইল সহ্য করা হবে না। 

এই হামলা ও পাল্টাপাল্টি হামলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যারা তারা কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ। নিয়ন্ত্রণরেখার দুই পাশের বাসিন্দারা চরম অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কে রাত কাটিয়েছেন। 

দ্য গার্ডিয়ানের নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিবেদক জেসন বার্ক ১৯৯৯ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কাভার করেছিলেন। সেইসময়ের কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ১৯৯৯ সালের যুদ্ধ ছিল পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে চতুর্থ এবং কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া তৃতীয় যুদ্ধ। গত কয়েক দশকে প্রযুক্তি আর আঞ্চলিক রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এলেও, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর অঞ্চল কাশ্মীর নিয়ে সৃষ্ট দুই দেশের শত্রুতায় খুব একটা হেরফের হয়নি—সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো তা আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। যদিও যুদ্ধবিরতিতে আপাতত গোলাগুলি থেমেছে, তবে আবারও যে অস্ত্র কথা বলবে না, এমন নিশ্চয়তা নেই।

আন্তর্জাতিক শক্তির মধ্যস্থতায় এমন সাময়িক যুদ্ধবিরতি দুই কাশ্মীরের মানুষ এর আগেও দেখেছে। হামলা বা বয়ানের রাজনীতি নয় এখন জরুরি হলো কাশ্মীর সংকটের স্থায়ী সমাধান। নইলে এই অঞ্চলে শান্তি স্থায়ী হবে না।

Comments

The Daily Star  | English

Govt unveils new 5-year plan to bolster fiscal governance

The Finance Division under the finance ministry has launched its third Public Financial Management (PFM) Reform Strategy, a five-year plan designed to shift fiscal governance from system-based reforms to outcome-driven accountability and service delivery..For the first time, the plan mains

Now