যেভাবে বাংলা শিখবে

স্টার অনলাইন গ্রিাফিক্স

ইদানিং প্রায়ই বন্ধুবান্ধব ও সমবয়সী ভাইবোন বা পরিচিতদের সঙ্গে কথা হয় তাদের বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করানো নিয়ে। আমার স্কুল-কলেজের পড়াশোনা ইংরেজি মাধ্যমে বলে তারা আমার কাছ থেকে পরামর্শ নিতে আসেন বিভিন্ন বিষয়ে।

কোন স্কুলটা ভালো হবে, ও-লেভেল এবং এ-লেভেল পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটা শেষ করতে কতো টাকা খরচ হতে পারে, বাসায় আলাদা করে শিক্ষক রাখতে হবে কিনা, এ-লেভেল পাশ করার পর দেশে থাকলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাবে কিনা ইত্যাদি। একেকজনের প্রশ্ন একেক রকম।

কিন্তু, একটা প্রশ্ন সবাই করেন আর সেটাকে প্রশ্ন না বলে ভয় বলাই ভালো— ‘ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়লে তো বাংলাটা শেখা হবে না। নিজের ভাষাটা যদি একটুও না পারে তাহলে কেমন করে হবে?’

প্রশ্ন বা ভয় যাই বলি না কেন সেটা একেবারেই অমূলক নয়। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে যেভাবে পড়াশোনা হয় তাতে বাংলাকে গুরুত্ব দেওয়াটা একটু কঠিন। অসম্ভব বলছি না। চাইলে বাংলাকে গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব। সেজন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের সমান সদিচ্ছা প্রয়োজন।

পাঠকরা হয়তো ভাবছেন যে আমি ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র হয়ে এভাবে স্বাভাবিক বাংলা কিভাবে লিখছি। হয়তো ভাবছেন, আমার এই লেখাটা কেউ সম্পাদনা করে দিয়েছেন। কিন্তু সত্যি কথা হলো— ইংরেজি মাধ্যমে পড়লেও বাংলাটাও আমি ইংরেজির মতোই পারি। আমাকে যারা চেনেন, তারা তা জানেন। সেটা কিভাবে সম্ভব হলো তাই এই লেখার বিষয়বস্তু।

১৯৯০ এর দশকে আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানোটা ছিল বিলাসিতা। শুধুমাত্র ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোই তাদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর কথা ভাবতে পারতেন। মধ্যবিত্তদের পক্ষে সেটা ছিল খুবই কঠিন।

এর মধ্যে আমার বাবা ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি নিজে পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে। একেবারে গ্রামের স্কুল ও জেলা পর্যায়ের কলেজে পড়াশোনা শেষ করে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। সুতরাং, ইংরেজি শেখার তেমন কোনো সুযোগ তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পাননি। তারপরও, ইংরেজি তিনি যথেষ্ট ভালো পারতেন। বিশেষ করে, ইংরেজি ব্যাকরণের ওপর তার দখল ছিল চমৎকার।

তার একটা ধারণা ছিল যে বাংলামাধ্যমে পড়াশোনা করলে ইংরেজি শেখাটা কঠিন। আর ইংরেজি না জানলে কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে হয়। তাই, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে আমাকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াবেন। নিজে একদম আটপৌঢ়ে মধ্যবিত্ত ছিলেন। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর খরচ টানা তার জন্য খুবই কঠিন ছিল। তারপরও দাঁতে দাঁত চেপে চালিয়ে গেছেন।

টাকার জন্য কোনো পরীক্ষা দিতে পারিনি— এমনটি কখনো হয়নি। ধারকর্য করে হলেও আমার পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছেন।

আমাকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর সিদ্ধান্তের পাশাপাশি একটা খুবই কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। তা হলো স্কুলের পাঠ্যবইয়ের বাইরে আমাকে কোনো ইংরেজি গল্পের বই বা ছবির বই বা কমিক বই কিনে না দেওয়া।

তার বক্তব্য ছিল: ‘স্কুলে তো সারাক্ষণ ইংরেজি বই পড়বে, ইংরেজিতে কথা বলবে, ইংরেজি লিখবে। ওতেই ইংরেজিটা শেখা হয়ে যাবে। তাই বাসায় এসে আর ইংরেজি দরকার নেই।’

আমাকে খুব ছোটবেলা থেকেই বাবা অনেক বাংলা গল্পের বই কিনে দিতেন। ছবির বই বা কমিক বইয়ের বাইরে আমাকে প্রথম যে হার্ডকভার গল্পের বইগুলো তিনি কিনে দিয়েছিলেন সেগুলোর কথা আমার এখনো পরিষ্কার মনে আছে। সেগুলো হাজারবার করে পড়েছি।

এর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল সত্যজিৎ রায়ের ‘সুজন হরবোলা’।

আরেকটি বইয়ের নাম ছিলে ‘চিল্ড্রেনসএপিকস’। এই বইটিতে ইলিয়াড, ওডিসি, মহাভারত ও রামায়ণের গল্প ছিল। তা অবশ্যই শিশুদের উপযোগী করে লেখা ছিল। যদিও লেখকের নাম এখন আর মনে নেই।

আরেকটা ছিল ‘ঠাকুরমার ঝুলি’।

যারা এই বইগুলো পড়েছেন, তারা খুব ভালো জানেন যে শিশুর মনে গল্প শোনা বা পড়ার আগ্রহ তৈরি করতে এই বইগুলোর কোনো জুড়ি নেই।

এরপর ধীরে ধীরে বড় হয়েছি। উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার রায় ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। আরেকটু বড় হলে নিজেই নিজের বইয়ের খোঁজ বের করা শিখে গিয়েছিলাম।

কাকাবাবু, ফেলুদা, তিন গোয়েন্দা, ঋজুদা, ঘনাদা… মুহম্মদ জাফর ইকবালের বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ও কিশোর গল্প, সেবার ওয়েস্টার্ন ও টুকটাক কিছু মাসুদ রানাও পড়া শুরু হয়ে গেল।

এরপর হাতে এলো হুমায়ূন আহমেদ ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বই।

ততদিনে আমার স্কুলে সবাই বুঝে গেছে যে রাজীব বাংলায় খুব ভালো। কারণ স্কুলের পড়াশোনার বাইরে আমি তখন গোগ্রাসে বাংলা গল্পের বই পড়ি। ইংরেজি মাধ্যমে অনেক উঁচু ক্লাসে যে ধরনের বাংলা পড়ানো হয় তা আমার জন্য ছিল একদমই শিশুতোষ!

তেমন কিছু না পড়েও আমি সহজেই সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে যেতাম। সবার চেয়ে বেশি নম্বর পাওয়ার একটা বড় কারণ ছিল বানান। আমার বন্ধুদের দেখেছি তারা রীতিমতো বাংলা শব্দের বানান মুখস্ত করতো। কিন্তু, আমি প্রচুর বাংলা বই পড়তাম বলে আমার কখনোই বানান ভুল হতো না। আসলে স্কুলে তখন সাকুল্যে ছয় দিন বাংলা পড়তাম আমরা।

সারা বছর চারটা ‘ক্লাস টেস্ট’, একটা হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা ও একটা ফাইনাল। সপ্তাহে একটা বা দুটো বাংলা ক্লাস হতো। সেসব ক্লাস যারা নিতেন তারাও নরম-সরম মানুষ ছিলেন। আসলে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বাংলা পড়ান বলে অন্যান্য ‘ইংরেজি জানা’ শিক্ষকদের সামনে তারা হয়তো একটু হীনমন্যতায় ভুগতেন। তাদের ক্লাসে ইচ্ছেমত দুষ্টামি করতাম আমরা।

এ ছাড়াও, বেশিরভাগ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বাংলার প্রতি অনাগ্রহের আরেকটি কারণ আছে। যেমন বলছিলাম, আমরা যখন স্কুলে পড়ি তখন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা খুব একটা ইংরেজি মাধ্যমে পড়তো না। বেশিরভাগই ছিল ধনী বা উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের। একটা জিনিস তারা খুব ভালো করে জানতেন যে পড়াশোনা শেষ করেই দেশের বাইরে চলে যাবে পড়তে। সেখানে তাদের বাংলা কোনো কাজে লাগবে না।

সত্যি বলতে কী, আমার স্কুল-কলেজের প্রায় ৭০ শতাংশ সহপাঠীই এখন দেশের বাইরে। তাদের বেশিরভাগই এ-লেভেল পাশ করে পড়তে গিয়ে আর ফেরেনি। অনেকেই আবার দেশে স্নাতক শেষ করে পড়তে গিয়ে আর ফেরেনি।

এটা ঠিক যে তাদের আর কখনো বাংলাটা খুব একটা দরকার হবে না। নিজের মাতৃভাষা ভালোভাবে না জানলেও তাদের কোনকিছুই আটকে থাকবে না।

রাজীব ভৌমিক: যোগাযোগকর্মী

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
Shibir-backed candidates Shadik, Farhad elected Ducsu VP, GS

Shibir-backed candidates Shadik, Farhad elected Ducsu VP, GS

Abu Shadik Kayem won 14,042 votes while Abidul Islam Khan, from the Jatiyatabadi Chhatra Dal-backed panel, got 5,708 votes.

2h ago